রপ্তানি পণ্যবাহী ১ হাজার ২১ কনটেইনার না নিয়েই গতকাল শুক্রবার তিনটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছেড়ে গেছে। গাড়িশ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে বেসরকারি ডিপোগুলো থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী এসব কনটেইনার বন্দরে আনা যায়নি। যার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে কোনো কর্মবিরতির কারণে এক দিনে এত বিপুলসংখ্যক রপ্তানি কনটেইনার ফেলে যাওয়ার নজির খুব কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়িচালকদের এই কর্মবিরতি শুরু হয় গত বুধবার। প্রথম দিন রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে সমস্যা হয়নি। দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার থেকে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। ওই দিন রপ্তানি পণ্যবাহী ১০১ বক্স কনটেইনার বা ১৮০টি একক কনটেইনার ছাড়াই দুটি জাহাজ বন্দর ছেড়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত দুই দিনে ১ হাজার ২০০ একক কনটেইনার পণ্য রপ্তানি হয়নি।
পণ্যবাহী যে কনটেইনারগুলো জাহাজে তুলে দেওয়া যায়নি সেগুলোর গন্তব্য ছিল ইউরোপ–আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। আর রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশই পোশাক খাতের। এসব পণ্যবাহী কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রথমে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরে নেওয়া হতো। এরপর সেখান থেকে বড় জাহাজে (মাদার ভেসেল) করে ইউরোপ–আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নেওয়ার কথা ছিল।
বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা পণ্যবাহী এসব কনটেইনার ডিপোতেই বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এ বিষয়ে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে জানান, নির্ধারিত জাহাজে এসব মালামাল তুলে দিতে না পারায় সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও পোর্ট কেলাং বন্দরে অপেক্ষমাণ বড় জাহাজের শিডিউল ধরতে পারবে না। ফলে এসব রপ্তানি পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের হাতে সময়মতো পৌঁছানো যাবে না, যা রপ্তানিকারকদের ক্ষতির মুখে ফেলবে। করোনাভাইরাসের সংকটের সময় নতুন এই সমস্যা দেশের রপ্তানি খাতে বড় ক্ষত তৈরি করছে।
৮৫০টি প্রাইম মুভার ট্রেইলার চলাচল বন্ধ।
দুদিনে ১২০০ কনটেইনার ফেলে বন্দর ছেড়েছে ৫টি জাহাজ
কর্মবিরতি অব্যাহত থাকলে রপ্তানিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে
নিয়োগপত্রের দাবিতে গত বুধবার সকাল থেকে আকস্মিক কর্মবিরতি শুরু করে কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়িচালক ও শ্রমিকদের সংগঠন ‘প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়ন’। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর ও ডিপোর মধ্যে চলাচলকারী ৮৫০টি প্রাইম মুভার ট্রেইলার গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসব গাড়িতে করে ডিপো থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, গতকাল কলম্বোগামী ‘এমভি এক্সপ্রেস নাপসি’ জাহাজে রপ্তানি পণ্যবাহী ১ হাজার ৫৫০ একক কনটেইনার নেওয়ার বুকিং ছিল। কিন্তু জাহাজটিতে রপ্তানি পণ্যবাহী ৯৮৪ একক কনটেইনার বোঝাই করা সম্ভব হয়েছে। কর্মবিরতি শুরুর আগেই ডিপো থেকে এসব কনটেইনার বন্দরে পৌঁছেছিল। কর্মবিরতির কারণে বন্দরে পৌঁছাতে না পারায় জাহাজটিতে ৫৬৫ একক কনটেইনার তোলা যায়নি। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুরগামী ‘এমভি সোল অব লাক’ ৩৪৩টি এবং মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাংগামী ‘এমভি এলা’ জাহাজটিতে ১১৩ একক কনটেইনার তুলে দেওয়া যায়নি।
এমভি এক্সপ্রেস নাপসি জাহাজ পরিচালনাকারী সি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকেরা গাড়ি না চালানোর কারণে ডিপো থেকে কনটেইনার বন্দরে আনা যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে এসব কনটেইনার ফেলে বন্দর ছাড়তে হয়েছে।
রপ্তানি পণ্যের ৮৯ শতাংশ চট্টগ্রামের ১৮টি ডিপোতে এসে জমা হয়। এরপর সেখান থেকে এসব পণ্য কনটেইনারে বোঝাই করে বন্দরে নিয়ে অপেক্ষমাণ জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। ডিপো থেকে রপ্তানি পণ্য পরিবহন বন্ধ হওয়ায় এখন শুধু ঢাকার কমলাপুর ডিপো, পানগাঁও টার্মিনাল ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল থেকে পণ্য বন্দরে পৌঁছানো যাচ্ছে, যা দেশের মোট রপ্তানি পণ্যের ১১ শতাংশের মতো। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কর্মবিরতি অব্যাহত থাকলে রপ্তানি পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়বে। কারণ, গতকাল পর্যন্ত ডিপোতে প্রায় ৯ হাজার কনটেইনারে বোঝাই করা হয়েছে। এগুলো ডিপোতেই পড়ে আছে।
রপ্তানি খাতের ক্ষতি করে কেন এই কর্মসূচি—জানতে চাইলে প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন বলেন, ডিপো মালিকেরা সেটা বোঝে না। নিয়োগপত্র না দিলে আগামী সোমবার ভোর থেকে সারা দেশের সব প্রাইম মুভার ট্রেইলার পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
তবে কনটেইনার ডিপো মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, নিয়োগপত্র দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। কিন্তু শ্রমিকদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে হবে।
দুই পক্ষের এই অবস্থানের মধ্যে ক্ষতির মুখে পড়ছেন রপ্তারিকারকেরা। কারণ, চট্টগ্রাম থেকে কনটেইনার জাহাজীকরণে এক দিন পেছালে সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা মালয়েশিয়ার বন্দরে বড় জাহাজে তোলা অন্তত এক সপ্তাহ পিছিয়ে যায়। আর প্রাইম মুভার ট্রেইলারের চালকদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকলে পণ্য রপ্তানিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।