করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পেতে রাজধানী অলিগলির ওষুধের দোকান, ভ্যানগাড়ি ও ফুটপাতে চৌকির ওপর মাদুর বিছিয়ে হ্যান্ড-স্যানিটাইজার, মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস বিক্রির হিড়িক পড়েছে। তবে এসব সুরক্ষাসামগ্রীর মান নিয়ে ব্যবহারকারীরা সচেতন না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা মানহীন সুরক্ষাসামগ্রী তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা বলছেন, এসব মানহীন সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করলে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। নকল ও মানহীন সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করা না করা একই।
তারা বলছেন, বাজারে যেসব মাস্ক বিক্রি হচ্ছে সেগুলো ধুলাবালি ও ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেবে কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পাওয়া যাবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাস সুরক্ষায় বাড়ির বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করলেও মানসম্মত মাস্কের সংকট রয়েছে বাজারে। ফলে জনসাধারণ বাধ্য হয়ে মানহীন মাস্ক কিনছেন। ১২ আগস্ট বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর তাঁতীবাজার মোড়, বাবুবাজার ব্রিজ, গুলিস্তান ও শাহবাগে সড়কের দু’পাশে ফুটপাতে মানহীন মাস্ক, পিপিই ও হ্যান্ড-স্যানিটাইজার নিয়ে শত শত দোকান বসেছে। আগে যেসব সার্জিক্যাল মাস্ক বাজারে প্রতি পিস কমেবিশ ৫০ টাকা বিক্রি হতো এখন তার জোড়া ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এন-৯৫ মাস্ক প্রতি পিস আগে দেড়শ’ টাকা বিক্রি হলেও এখন ৬০ টাকায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ এসব নকল সুরক্ষাসামগ্রী কিনছে। আসল হ্যাক্সিসল, হ্যান্ড রাবের বোতল সংগ্রহ করে রং মেশানো পানি ভরে বাজারে বিক্রি করছে মুনাফালোভীরা। অনেক বোতলের ওপর কিছু লেখা নেই, কিন্তু হ্যান্ড রাব ও হ্যাক্সিসল বলে বিক্রি করছে। নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত দাম। বোতলের গায়ে হ্যান্ড রাব লেখা জীবাণুমুক্ত করার তরল ৩৫০ মিলিলিটার ১৬০ টাকা, ১০০ মিলি ৭০ টাকা। পণ্যগুলো কোন প্রতিষ্ঠান আমদানি করছে, কোথাও উল্লেখ নেই। মানহীন চিকিৎসা সামগ্রীর বিষয়ে মুগদা হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ কাশেম সংবাদকে বলেন, বাজারে যেসব মাস্ক, পিপিই বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো করোনা থেকে মানুষকে কখনই সুরক্ষা দেবে না। বাজারের সার্জিক্যাল মাস্ক কিংবা ‘এন-৯৫’ মাস্ক রয়েছে তা মানহীন। এগুলো মাস্ক দেশে তৈরি হয়, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মানহীন মাস্ক ব্যবহারে মানুষের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাবে। নাকের ও মুখের ব্যাকটেরিয়া বের হতে পারবে না। ফলে মানুষ নিজের ব্যাকটেরিয়ায় নিজেই আক্রান্ত হবেন। এসব মানহীন মাস্ক ব্যবহার না করাই ভালো বলে মনে করেন ডাক্তার।
জানা গেছে, করোনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা বাড়ায় ভেজাল এন-৯৫ মাস্ক, টেস্ট কিট, গ্লাভস তৈরি করতে শুরু করেছে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র। বিশেষ করে রাজধানীর অলিগলিতে তৈরি হচ্ছে এসব মানহীন সুরক্ষাসামগ্রী। অনেকে বিদেশ থেকে মানহীন পণ্য এনে অভিজাত ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারজাত করছে। মানহীন পণ্যই বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করছেন সবশ্রেণী পেশার মানুষ। ফলে দেশে এসব সামগ্রীর সংকট রয়েছে। এ সংকট কাজে লাগিয়ে মানহীন সুরক্ষাসামগ্রী তৈরি করে বাজারে সরবরাহ করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাজারের পিপিই বা সুরক্ষাসামগ্রী অধিকাংশই মানহীন। যা মোটেও ভাইরাস থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারছে না। এ ধরনের পিপিই ও মাস্ক ব্যবহার বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সারোয়ার আলী সংবাদকে বলেন, রাস্তাঘাটে কিংবা শপিংমলে যাতাযাতে তিনপর্দা কাপড়ের তৈরি মাস্কই সাধারণ মানুষের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু করোনা রোগীর সংস্পর্শে যেতে ‘এন-৯৫’ মাস্ক পড়া উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য করোনা সুরক্ষায় মাস্কের পাশাপাশি মানুষের দূরত্ব বজায় রাখতে গুরুত্ব দিচ্ছে। মাস্ক, পিপি ও চিকিৎসা সামগ্রী তৈরিতে সুনির্দিষ্ট মানদ- দরকার। প্রথম দিকেই সরকারের এটি যাচাই করেনি। ফলে অসাধু, দুর্নীতি ও অবহেলায় এটি হয়েছে। আগামীতে এ ব্যাপারে সরকারের নজরদারি বাড়বে।
করোনাভাইরাসে অনেকের চাকরি চলে যাওয়া বা পুরনো ব্যবসা পরিবর্তন করে চিকিৎসা সামগ্রী বেচাকেনা করছে। তাদের মধ্যেই একজন রুবেল হোসেন। গুলিস্তানে ফুটপাতে হাতে সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি করছেন। করোনাভাইরাসে তার চাকরি চলে যাওয়া জীবন বাঁচাতে ফুটপাতে মাস্ক বিক্রি করছেন। রুবেল বলেন, মানহীন বা মানসম্মত মাস্ক চিনি না। কয়েকদিন আগে আম, লিচু বিক্রি করতেন, এখন মাস্ক বিক্রি করছেন।
চীন থেকে চিকিৎসা সুরক্ষাসামগ্রী আমদানি করছে অ্যাডভান্স মেডিকেল রিক্রুটমেন্ট নামে একটি কোম্পানি। এই কোম্পানির পরিচালক আবদুল্লাহ আল কাফি সংবাদকে বলেন, কোন মেডিকেল পণ্য আমদানি করতে হলে প্রথমেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সিই সার্টিফিকেট, এফডিএ সার্টিফিকেট, আইএসও সনদ, আমদানিকারক যার কাছ থেকে পণ্য কিনেছেন সেই রপ্তানিকারককে বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে কিনা সেই অথরাইজেশনসহ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে আমদানির অনুমতি পত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। এসব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন পেলে এলসি করার পরে চীন থেকে পণ্য দেশে আসতে প্রায় একমাস চলে যায়।
নিরাপদ খাদ্য ও ভোক্তা অধিকার আন্দোলন সংগঠনের প্রধান নির্বাহী কামরুজ্জামন বাবলু সংবাদকে বলেন, বাজারের মানহীন চিকিৎসা সামগ্রী জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। করোনায় সংক্রমিত হয়ে মানুষ যতটুকু ভয়ে আছে, এর চেয়ে বেশি ভয়ে আছেন মানহীন চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে। মানুষ মানহীন মাক্স, পিপিই ও হ্যান্ড-স্যানিটাইজার কিনে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। এসব মানহীন চিকিৎসা সামগ্রীর বিরুদ্ধে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেটি লোক মাত্র। প্রাণঘাতী করোনভাইরাসের চিকিৎসা সামগ্রী রাস্তাঘাটে বেচাকেনা বন্ধ করে রেজিস্ট্রার ফার্মেসিতে বিক্রি করার দাবি জানায় সংগঠনটি।
ভোক্তা অধিদফতরের ম্যাজিস্ট্রেট মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, অনেকেই মানহীন পণ্য অভিজাত ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারজাত করছে। এসব নকল পণ্যই বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে। করোনাভাইরাসের মধ্যেও ভেজাল ও নকল বিরোধী অভিযান চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।