পেট্রল ও ডিজেলচালিত মোটরগাড়ি একদিন উঠে যাবে। সেই জায়গায় আসবে ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল বা বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি)। বিশ্বের বড় বড় সব গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি এখন এই বৈদ্যুতিক গাড়ির নতুন নতুন মডেল উদ্ভাবন ও তৈরির কাজে বেশ মনোযোগী।
আসছে বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগ
আর দু-তিন দশকের মধ্যেই বিশ্বে পেট্রল ও ডিজেলচালিত মোটরগাড়ি অতীত হয়ে যাবে। কারণ, কার্বন নিঃসরণ কমাতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে জ্বালানি তেলের পরিবর্তে বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ির জগতে প্রবেশ করবে অটোমোবাইল শিল্প। ফলে বৈশ্বিক গাড়ির বাজার চলে যাবে পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) দখলে। সে জন্য দুনিয়ার তাবৎ সব বড় বড় গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি এখন বৈদ্যুতিক গাড়ির নতুন নতুন মডেল তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ১৯১৩ সালে হেনরি ফোর্ড প্রথমবারের মতো মোটরগাড়ি উৎপাদন শুরু করার পর বৈশ্বিক গাড়ি শিল্পে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটতে চলেছে। এই বিপ্লব আপনার কল্পনার চেয়েও দ্রুত ঘটবে। বদৌলতে পেট্রল ও ডিজেলচালিত মোটরগাড়িকে হটিয়ে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়িই বাজার দখল করে নেবে। সে রকম পরিকল্পনা নিয়েই এখন গাড়ি নির্মাতারা এগোচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাতা জাগুয়ার ২০২৫ সাল নাগাদ ব্যাটারি তথা বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ি বাজারে আনতে চায়। তারা ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ‘ব্রাসেলস এক্সপো’ শীর্ষক মেলায় জাগুয়ার ওয়ান পেস গাড়ি প্রদর্শন করেছে। সুইডেনের বহুজাতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক ভলভো অবশ্য আরও পাঁচ বছর সময় নিয়ে ২০৩০ সালের দিকে এই গাড়ি বাজারে ছাড়বে। যুক্তরাজ্যের স্পোর্টস কার কোম্পানি লোটাস ২০২৮ সালে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জেনারেল মোটরস (জিএম) ২০৩৫ সালে ইলেকট্রিক গাড়ি বাজারে নিয়ে আসবে। অর্থাৎ ব্যবহার বাড়লে দাম কমবে, আবার দাম কমলেও ব্যবহার বাড়বে। জেনারেল মোটরস এর আগে ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে ইভি ওয়ান নামে একটি পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেল উদ্বোধন করে। এ জন্য শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করলেও কোম্পানিটির সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। অবশেষে দুই দশক পরে আবার তারা ইভি উৎপাদনের পথে এসেছে।
আসছে বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগ
ছবি: রয়টার্স
সেই দেশের বৃহৎ আরেক গাড়ি প্রস্তুতকারক ফোর্ড মোটরও জানিয়েছে, তারা ২০৩০ সাল নাগাদ ইউরোপে যত গাড়ি বিক্রি করবে তার সবগুলোই হবে বিদ্যুৎ–চালিত।
আবার জার্মানির গাড়ি প্রস্তুতকারক ফক্স ওয়াগনও জানিয়েছে, ২০৩০ সালে তাদের বিক্রীত গাড়ির ৭০ শতাংশই হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি)।
জাপানের টয়োটা মোটর করপোরেশনও ২০২৫ সাল নাগাদ বৈশ্বিক বাজারে ব্যাপক হারে বৈদ্যুতিক গাড়ি সরবরাহ করতে চায়।
বৈদ্যুতিক গাড়ির বিকাশ অনেকটা ইন্টারনেট বিপ্লবের মতো হবে। বলা হচ্ছে, গত শতকের নব্বইয়ের দশক বা এই শতকের শুরুতে পৃথিবীব্যাপী কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও বিশ্বের শীর্ষ ধনী জেফ বেজোসের আমাজন কিংবা সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহু ও গুগলসহ অনলাইনভিত্তিক নানা ধরনের সেবার প্রচলন যেভাবে দ্রুতগতিতে বিকশিত হয়েছে, ঠিক সেভাবে বৈদ্যুতিক গাড়িও দ্রুত বাজার দখল করে নেবে। স্মার্টফোন এসে তো ইন্টারনেটভিত্তিক সেবায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। সে রকম বড় বিপ্লবই আশা করা হচ্ছে বৈশ্বিক গাড়ি শিল্পে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্লিন এনার্জি রিসার্চ গ্রুপ আরএমআইর কর্মকর্তা ম্যাডেলিন টাইসন বলেন, এক দশক আগে তেসলার মতো একটি বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করাতে ঘণ্টায় প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের খরচ পড়ত এক হাজার ডলার। তা কমে এখন ১০০ ডলারে নেমে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
পর্যবেক্ষকেরা বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেন, দিন দিন ব্যবহার ও বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থাৎ বাজার সম্প্রসারণের ফলে কম্পিউটারের দাম ও ইন্টারনেটের খরচ কমেছে। আবার দাম কমার কারণেও বাজার বেড়েছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, ১৯৯৫ সালে বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ, যা ২০০১ সালে বেড়ে হয় ৫১ কোটি ৩০ লাখ। আর এখন বিশ্বে ৩০০ কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। একইভাবে ইভি গাড়ির ব্যবহার মানে বাজার বাড়বে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ ব্যবহার বাড়লে দাম কমবে, আবার দাম কমলেও ব্যবহার বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্লিন এনার্জি রিসার্চ গ্রুপ আরএমআইর কর্মকর্তা ম্যাডেলিন টাইসন বলেন, এক দশক আগে তেসলার মতো একটি বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি চার্জ করাতে ঘণ্টায় প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের খরচ পড়ত এক হাজার ডলার। তা কমে এখন ১০০ ডলারে নেমে এসেছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের কোম্পানি তেসলার সর্বশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি মডেল থ্রি একবার চার্জ করলে ৩০০ মাইল পর্যন্ত চলতে পারে। আর ৩ দশমিক ১ সেকেন্ডের মধ্যে এই গাড়ির গতি শূন্য থেকে ৬০ কিলোমিটারে ওঠে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিশ্বে ২০২০ সালে অন্য সব মোটরগাড়ির বিক্রি যেখানে কমেছে, সেখানে ইভি গাড়ির বিক্রি ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। মোট গাড়ি বিক্রি হয়েছে ৩২ লাখ।
ইলন মাস্ক গত মাসে জানিয়েছিলেন, তাঁর কোম্পানি তেসলার তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেল থ্রি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। আর তুলনামূলক সস্তা দামের মডেল ওয়াই অন্য সব গাড়ির চেয়ে বেশি বিক্রি হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতি গ্রাহকদের মধ্যে প্রবল আগ্রহ বিষয়টি লক্ষ করেছি।’
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ইউবিএসও বলেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বে মোট গাড়ি বিক্রির ২০ শতাংশ হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি। এই হার ২০৩০ সালে ৪০ শতাংশে উন্নীত হবে। আর ২০৪০ সালে যত গাড়ি বিক্রি হবে তার সবগুলোই হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি। এ ধরনের গাড়ির উৎপাদন বাড়লে দামও কমবে। তখন আর বাজারে ডিজেল ও পেট্রলচালিত গাড়ি থাকবে না।
তবে বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনলেই তো আর হবে না, বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে কম খরচে এখানে-ওখানে এটির ব্যাটারি চার্জ করার সুবিধাও থাকতে হবে। এ জন্য অবশ্য নতুন বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। তবে সেটিও সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এক শ বছর আগে পেট্রল স্টেশন নেটওয়ার্কও এভাবেই দ্রুত গড়ে উঠেছিল।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সুবাদে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে সরকারগুলো এখন পেট্রল ও ডিজেলচালিত গাড়ি বিক্রি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। একই সঙ্গে তারা ইভির উৎপাদন ও ব্যবহার উৎসাহিত করতে সুবিধা দিচ্ছে।
যেহেতু দুনিয়ার বড় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে বড় বিনিয়োগ শুরু করেছে সেহেতু বাংলাদেশকেও একই পথে হাঁটতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারও এবারই প্রথম দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির মালিকদের বাজেটে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেটি অবশ্য করা হয়েছে অগ্রিম কর পরিশোধ বিষয়ে। বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী এই ধরনের গাড়ির মালিকদেরও অগ্রিম কর দিতে হবে। ৭৫ কিলোওয়াটের গাড়ির অগ্রিম কর দিতে হবে ২৫ হাজার টাকা। যত কিলোওয়াট বাড়বে, অগ্রিম করের পরিমাণও তত বাড়বে। ১৭৫ কিলোওয়াটের গাড়ির মালিককে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অগ্রিম কর দিতে হবে।
বিবিসি অবলম্বনে