সামাজিক যোগাযোগের প্লাটফর্ম টিকটকের মাধ্যমে ভারতীয় যুবকের সঙ্গে পরিচয়। এরপর সেখান থেকে ফেসবুকে চ্যাট, কথোপকথন। সম্প্রতি পাসপোর্টও করেন শ্রাবন্তী (ছদ্মনাম)। যাবেন ভারতীয় সেই বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে। এরই মধ্যে টিকটককাণ্ডে নারীপাচার ও শ্লীলতাহানির ভিডিও ভাইরাল হয়। ভয় চেপে বসে শ্রাবন্তীর মধ্যে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজমের সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন ওই তরুণী। জানান, তিনি প্রেমের কারণে ভারতে যেতে চান। পাচার হচ্ছেন না। টিকটকের সূত্রে প্রেম। তবে ভারতে গিয়ে ওই যুবকের কোনো ফাঁদে তিনি পড়বেন কি না— সে বিষয়ে সচেতন নন শ্রাবন্তী।
তারা বলছেন, ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলোর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অশ্লীল ভিডিও, বাজে কমেন্টস, প্রতারণার মতো ঘটনা ঘটছে হরহামেশা। এ কারণে সামাজিক এসব প্লাটফর্ম বন্ধ না করে আইনের মধ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনটেন্ট দিয়ে পরিচিতি পাওয়ার ইচ্ছা দোষের কিছু নয়। কিন্তু যেকোনো উপায়ে তারকা হওয়ার নেশা, পরিচিতি পাওয়ার নেশা এবং তা থেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়া ভালো কিছু নয়। যেনতেনভাবে তারকা হওয়ার হাতছানি তাদের নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে।টিকটককে ঘিরে আয়োজন হচ্ছে পুর পার্টি। যার আড়ালে চলে দেহ ব্যবসা, মাদকের আসর, মাদকের বেচা-কেনা। অ্যাপকেন্দ্রিক নৈতিক অবক্ষয়ের পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ। তাই এখনই এর লাগাম টানা উচিত।
সম্প্রতি ভারতে এক [বাংলাদেশি তরুণীকে বীভৎস কায়দায় যৌন নির্যাতনের ঘটনা ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, তিন-চারজন যুবক ও একটি মেয়ে মিলে ওই তরুণীকে বিবস্ত্র করে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করছে। ওই ঘটনার সূত্রপাত টিকটক অ্যাপ ঘিরে। ওই ভিডিওর সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে রিফাজুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয় নামের এক নির্যাতনকারীকে শনাক্ত করে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ।
টিকটক হৃদয় নামের ওই যুবক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু অপরাধীর সঙ্গে মিলে মানবপাচারের আন্তর্জাতিক চক্র গড়ে তোলেন। চক্রটির নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ কয়েকটি দেশে বিস্তৃত বলে দাবি পুলিশের।
ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারীপাচার সম্পর্কিত নতুন নতুন তথ্য আসছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার দরিদ্র পরিবারের দুই তরুণীকে টিকটকের আড়ালে চাকরি দেওয়ার নাম করে ভারতে পাচারের তথ্য পায় তদন্তসংশ্লিষ্টরা। পাচারের পর তাদের দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দিঘা এলাকার বিভিন্ন বাসা ও হোটেলে জোরপূর্বক দেহব্যবসায় নিয়োজিত করা হয়। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ১৬ মে লকডাউন শুরু হলে পাচারকারী চক্রের নজরদারি এড়িয়ে দুই বোন পালিয়ে দেশে ফেরেন।
একইভাবে ভারতে পাচার হওয়া এক তরুণী দুই মাসের অমানবিক নির্যাতনের পর গত ৭ মে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন। গত মঙ্গলবার হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। মামলার পর পুলিশ জানায়, ওই নারীকে পাচারে জড়িত ছিলেন ১২ জন। তাদের মধ্যে ভারতীয় সাতজন, দেশীয় পাঁচজন। দেশীয় পাঁচজনের মধ্যে মেহেদি হাসান, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদেরকে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার হওয়া মেহেদি হাসান দোষ স্বীকার করে পুলিশকে জানান, ওই তরুণীসহ দের হাজারের বিশি নারীকে ভারতে পাচার করেছেন তারা। এ বিষয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, টিকটকের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে পাচারকেন্দ্রিক অপচেষ্টা শুরু হয়। উঠতি বয়সী কিশোরী-তরুণীদের মডেল বা স্টার বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়। তাদের অবৈধ পথে ভারতে নেওয়া হয়।
সর্বশেষ গত রোববার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে লাইকি ও বিগো লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং অ্যাপ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতারের খবর দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা হলেন- মোস্তফা সাইফ রেজা (২৬), মো. আরিফ হোসেন (২৭), এস এম নাজমুল হক (২৭), আসমা উল হুসনা সেজুতি (২৮) ও অজ্ঞাত এক বিদেশি নাগরিক।
সিআইডি জানায়, লাইকি ও বিগো লাইভের মতো অ্যাপে ভিডিও স্ট্রিমিং লাইভ চ্যাট, ফিশিং গেমের অপশন রয়েছে। এসব ব্যবহারে প্রয়োজন হয় ডিজিটাল কারেন্সির। যার নাম ‘ডায়মন্ড’। বাংলাদেশি লক্ষাধিক এসব অ্যাপ ব্যবহারকারী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল কারেন্সি ডায়মন্ড ক্রয় করছে। বাংলাদেশি এজেন্সিগুলো ডায়মন্ড কিনে আনে বিদেশি অ্যাডমিনদের কাছ থেকে। এসব এজেন্সি বিভিন্ন অবৈধ মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।বলে জানিয়েছে সিআইডি।
এ বিষয়ে সিআইডির সাইবার বিভাগে প্রধান ডিআইজি জামিল আহমেদ বলেন, লাইকি ও বিগো লাইভ অ্যাপ বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমরা নিয়ন্ত্রণকারীদের এসব বিষয়ে নজরে আনব। এছাড়া আমরা এসব অ্যাপ সার্বক্ষণিক নজরদারি করছি। যারা অশ্লীল ভিডিও দিচ্ছেন তাদেরকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এসব অ্যাপের অফিস আমাদের দেশে খোলার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব।
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সাইবার ইন্টেলিজেন্স) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) সাঈদ নাসিরুল্লাহ বলেন, সাইবার অপরাধে জড়িতদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই তরুণ-কিশোর। ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামে অনেক সিকিউরিটি অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। কিন্তু টিকটক, লাইকি কিংবা বিগো লাইভের মতো অ্যাপগুলোতে অশ্লীল ভিডিও প্রচার ও প্রদর্শনী চললেও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
তিনি বলেন, ‘টিকটক, লাইকি কিংবা বিগো লাইভে নিজেকে স্টার কিংবা সেলিব্রেটি করার নামে অনেককে পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। অনেকে নিজের ইচ্ছায় চলে যাচ্ছে। এসব নিয়ে সাইবার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কাজ করছে। বিটিআরসির নির্দেশনায় এসব প্লাটফর্মকে নিয়ন্ত্রণে আনার কথা ভাবা হচ্ছে।’
ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, টিকটক ও লাইকি সিঙ্গাপুরের ব্যক্তিমালিকানা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। অ্যাপগুলো হয়তো বন্ধ করা হবে না। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় পর্নোগ্রাফি রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ চায় সরকার। টিকটক, লাইকি ও বিগো লাইভ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের চেষ্টা চলছে। করোনার কারণে দেরি হচ্ছে। হয়তো পরিস্থিতি বিবেচনায় ভার্চুয়ালিও বৈঠক হতে পারে। এসব করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে।
ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটায় সবকিছু এখন হাতের মুঠোয়। সহজলভ্য হচ্ছে অনেক কিছু। এর যেমন সুবিধা আছে, অসুবিধাও আছে অনেক। টিকটক, লাইকি কিংবা বিগো লাইভ এর উদাহরণ। অসুবিধার কারণে অনলাইন এসব প্ল্যাটফর্ম ঢালাও বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়। অপরাধ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়াই এখন বড় প্রয়োজন।
অ্যাপ বন্ধের বিপক্ষে মত দেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহাও। বলেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। অ্যাপ, গ্রুপ বা ওয়েব বন্ধ করা বা নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। একটা বন্ধ করলে বিকল্প আরও অনেক পথ খুলে যাবে। তাই প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।’
যোগাযোগ করা হলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘অপরাধ হচ্ছে। অশ্লীলতা বা দেশীয় কালচারবিরোধী চেষ্টা দমনে বা নিয়ন্ত্রণে যা যা করণীয় সেগুলো আমরা করছি। মূল বিষয় হচ্ছে, ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। এর আলোকে তারা করণীয় কী হতে পারে তা নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়কে অবগত করবে। এরপর আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেব।’
বিগো টেকনোলজির সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি
ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর তৎপরতা ও তদন্তে একমত পোষণ করে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিগো টেকনোলজি। রোববার (১৩ জুন) এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। একইভাবে প্রতিষ্ঠানটি যেকোনো ব্যক্তির দ্বারা অপরাধের ক্ষেত্রেও জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে।
বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, আমরা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করছি এবং যেভাবে সম্ভব বা প্রয়োজন এক্ষেত্রে আমরা সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে কাজ করব। আমাদের ব্যবহারকারীদের জন্য একটি নিরাপদ, সুরক্ষিত ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরিতে আমরা আগের মতোই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভবিষ্যতেও আমরা একইভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।
আঞ্চলিক ও জাতীয় আইন এবং মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে আমরা আইনপ্রয়োগকারী সব সংস্থা ও সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ব্যবহারকারীদের জন্য ইতিবাচক সব সুযোগ তৈরিতে নিবিড়ভাবে কাজ করব।