২০১২ সালে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে দুবাই যান নাঈম খান ওরফে লোটাস (৩১)। সেখানে কয়েক বছর কাজ করার পর জড়িয়ে পড়েন মানব পাচারে। দুবাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি বন্ধ থাকলেও দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা ছিল। সেখানকার কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় দুবাইয়ে অবস্থানকারীদের ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে বৈধতা দিচ্ছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নাঈম অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষকে দুবাইয়ে পাচার করেছেন। যাদের প্রত্যকের কাছ থেকে দুই লাখ থেকে শুরু করে তিন লাখ টাকা করে নিয়েছেন। ওয়ার্ক পারমিট পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তাদেরকে দুবাই নিয়ে গেলেও পরবর্তীতে তাদের অনেকেই কোনো কাজ পাননি। কাজ না পেয়ে অনেকে মানববেতর জীবনযাপন করছেন।
টাকা না থাকার কারণে তারা দেশেও ফেরত আসতে পারছেন না। আবার তার মাধ্যমে দুবাই যাওয়ার জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ভুয়া ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নিয়ে অনেকে বিমানবন্দরে ধরা পড়েন। এ রকম বেশকিছু ভুক্তভোগীর অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে র্যাব’র হাতে ধরা পড়েন নাঈম। র্যাব জানিয়েছে, সম্প্রতি বেশকিছু শ্রমিক বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া দুবাই যেতে চাচ্ছিলেন না। পরে নাঈম ভুয়া বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে সমপ্রতি বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীকে অবৈধভাবে বিদেশ পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা ধরা পড়েন শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগে। বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত করে এবং ভিকটিমদের বিদেশ যাত্রা স্থগিত করে। এ রকম ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে র্যাব-৩ ছায়া তদন্ত শুরু করে এই চক্রের সন্ধান পায়। পরে র্যাব-৩ একাধিক দল রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকায় শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে মানবপাচার চক্রটির মূলহোতা নাঈম খান ওরফে লোটাসসহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলো- নুরে আলম শাহ্রিয়ার (৩২), রিমন সরকার (২৫), গোলাম মোস্তফা সুমন (৪০), বদরুল ইসলাম (৩৭), খোরশেদ আলম (২৮), মো. সোহেল (২৭) ও মো. হাবিব (৩৯)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৪টি পাসপোর্ট, ১৪টি নকল বিএমইটি কার্ড, একটি সিপিইউ, একটি প্রিন্টার, একটি স্ক্যানার, দুই বক্স খালি কার্ড, পাঁচটি মোবাইল ফোন, একটি চেক বই, পাঁচটি নকল সিল উদ্ধার করা হয়। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল রকিবুল হাসান।
র্যাব সিও জানান, এই চক্রের মূলহোতা নাঈম খান ওরফে লোটাস (৩১) দুবাই প্রবাসী। ২০১২ সালে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে দুবাই যান। চলতি বছরের মে মাসে দেশে ফেরত আসেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। দুবাই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা থাকায় দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় সেখান অবস্থানকারীদের ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে কাজের বৈধতা দেয়। ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নাঈম মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন। নাঈম দুবাইয়ে ও বাংলাদেশে তার পরিচিতদের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেন। ভুক্তভোগীরা রাজি হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে যান নাঈম। তবে ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর তাদের কেউ কেউ কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এভাবে গত সাত বছরে পাঁচ শতাধিক মানুষকে দুবাই পাচার করেছেন। মানবপাচার থেকে অর্জিত অবৈধ উপার্জন দিয়ে তিনি দুবাইয়ে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিয়ে রেসিডেন্স ভিসার অনুমোদন নেন।
রকিবুল হাসান বলেন, আমরা নাঈমকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি আমাদেরকে জানিয়েছেন, দুবাইয়ে ফারুক নামে তার একজন সহকারী আছে। বাংলাদেশে তার মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করেন নুরে আলম শাহরিয়ার। তিনি মূলত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে দেন। তার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান রয়েছে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেই ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সমপ্রতি কিছু ভুক্তভোগী বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানালে শাহরিয়ারের মাধ্যমে বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্র মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়।
র্যাব জানিয়েছে, বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের মূলহোতা হাবিব এবং খোরশেদ। তারা দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত গোপনে নিজেদেরকে আড়ালে রেখে বিশ্বস্তদের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে আসছেন। দীর্ঘদিন ধরে নাঈম বিএমইটি কার্ড ছাড়াই মানবপাচার করে আসছিলেন। ভুক্তভোগীরা বিএমইটি কার্ড দাবি করলে শাহরিয়ার তার চাচা গ্রেপ্তার গোলাম মোস্তফা সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি একটি বিএমইটি কার্ড দেন। নাঈম ভুক্তভোগীদের বিএমইটি কার্ড সংগ্রহ করার জন্য শাহরিয়ারের মাধ্যমে ১৩টি পাসপোর্ট সুমনের কাছে হস্তান্তর করেন। শাহরিয়ারের নির্দেশেই জাল বিএমইটি কার্ড সুমনের কাছে থেকে সংগ্রহ করে নাঈমের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার হাবিব প্রাথমিক জিজ্ঞাসবাদে তাদেরকে জানিয়েছেন, মহসিন নামের একজনের কাছ থেকে তিনি খালি কার্ড কিনেন। প্রকৃত বিএমইটি কার্ড স্ক্যান করে নিজেই গ্রাফিক্স করেন। তারপর ভিকটিমের পাসপোর্টে দেয়া তথ্য অনুযায়ী কার্ডের পেছনে তথ্য লিপিবদ্ধ করে এবং বদরুলের নির্দেশমতো রিক্রুটিং লাইসেন্সের নম্বর বসিয়ে দিতেন। হাবিব চার বছর ধরে ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ডের ডিজাইন এবং প্রিন্টের ব্যবসা করে আসছেন। দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে হাবিব কাস্টমারদের চাহিদামতো সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নকল কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করতেন। র্যাব জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানায় মামলা হয়েছে।