পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নারী সেবার এক বছরের পরিক্রমা ড. বেনজীর আহমেদ

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নারী সেবার এক বছরের পরিক্রমা ড. বেনজীর আহমেদ

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন তার কার্যক্রমের এক বছর পূরণ করল। এই এক বছরে কার্যক্রমটি ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন পরিষেবাটি নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগ গ্রহণ করে এবং অভিযোগকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকে। সাইবার বুলিং, ট্রলিং, পরিচিতি তথ্য অপব্যবহার ও প্রকাশ, ব্ল্যাকমেইলিং, রিভেঞ্জ পর্নোসহ বিভিন্ন উপায়ে সাইবার স্পেসে যত হয়রানির ঘটনা ঘটে তার প্রধান শিকার হন নারীরা। ভুক্তভোগী নারীরা অধিকাংশ সময় বুঝতে পারেন না কীভাবে, কী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং কাকে বিষয়টি জানাবেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারকে জানাতে বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে তারা অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে দ্বিধাবোধ করেন। এই নারীদের পাশে দাঁড়াতে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন যাত্রা শুরু করেছিল। ‘নারীর জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিতকরণ’ এ রূপকল্প নিয়ে পরিষেবাটি চালু হয়েছিল। সাইবার স্পেসে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে প্রযুক্তিগত ও আইনি সহায়তা দেওয়া এবং সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করাই এ সেবার মূল উদ্দেশ্য।

ভুক্তভোগী নারীরা যাতে সহজেই তাদের হয়রানির বিষয়টি জানাতে যোগাযোগ করতে পারেন সেজন্য এ সার্ভিসের একটি হটলাইন নম্বর (০১৩২০-০০০৮৮৮) রয়েছে। এ ছাড়া তাদের সমস্যা পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের ফেসবুক পেজে মেসেজ পাঠিয়ে এবং ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও জানাতে পারেন।

গত এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কার্যক্রম শুরুর পর ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সঙ্গে মোট ১৭ হাজার ৭৭০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে ১২ হাজার ৯৪১ জন ভুক্তভোগী নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির সমাধান পেতে যোগাযোগ করেছেন। ৮ হাজার ৩৩১ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ এবং সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব পন্থায় নারীদের সাইবার স্পেসে হয়রানি করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো-

১. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপন ও কথোপকথনের মাধ্যমে ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে ব্ল্যাকমেইল করা। ২. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও বা পরিচিতি তথ্য প্রকাশ করে হয়রানি করা। ৩. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর ছবি পাঠিয়ে বা আপত্তিকর ভাষায় নারীকে মেসেজ পাঠিয়ে হয়রানি করা। ৪. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি হ্যাক করে তাতে থাকা ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে ব্ল্যাকমেইল করা। ৫. মোবাইল ফোনে কল করে হয়রানি।

অভিযোগকারীরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাইলে প্রাথমিকভাবে প্রযুক্তিগত তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়। এর পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ ইউনিটের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি নারীদের মধ্যে সাইবার সচেতনতা বাড়াতে এ পরিষেবা নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ভুক্তভোগী নারী যাতে দ্বিধাহীনভাবে ও নির্বিঘেœ তার অভিযোগ জানাতে পারেন সেজন্য এই সেবার সব পুলিশ সদস্য নারী।

সাইবার অপরাধ বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে সাইবার স্পেসে পরিচয় লুকানো সহজ। এর মাধ্যমে যে কোনো স্থানে বসে শুধু ইন্টারনেট ব্যবহার করে অপরাধ করা যায়। সামাজিক যোগাযোমাধ্যমে কোনো তথ্য প্রকাশ হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যনতুন ডিভাইস ও অ্যাপস ব্যবহার করে সাইবার অপরাধ সংঘটন করা যায়।

প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি, যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে বিভিন্ন বয়সী নারী ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে মোট অভিযোগকারীর ১৬ শতাংশ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের কম বয়সী। ৫৮ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৪ বছর থেকে ৩০ বছর বয়সী ভুক্তভোগী ২০ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ৩০ বছরের বেশি।

উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক ভুক্তভোগী (মোট অভিযোগের ৬৪ শতাংশ) এবং চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৭ শতাংশ ভুক্তভোগী পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ থেকে ৪ শতাংশ করে ভুক্তভোগী যোগাযোগ করেছেন। বরিশাল থেকে ৩ শতাংশ এবং রংপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ২ শতাংশ করে ভুক্তভোগী যোগাযোগ করেছেন।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নিয়মিত হটলাইনে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কল পেয়ে থাকে। এখানে সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী নারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের অভিযোগ জানান। হটলাইন নম্বরে কলের মাধ্যমে সমস্যা শোনা হয় এবং আইনগত প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি ভুক্তভোগীদের জন্য প্রাথমিক কাউন্সেলিং হিসেবে কাজ করে। প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাইবার অপরাধ প্রাথমিকভাবে তথ্যানুসন্ধান করে অভিযুক্তকে শনাক্ত করে। বাংলাদেশের যে স্থানে অপরাধী অবস্থান করছে বলে জানা যায়, সে স্থানের সংশ্লিষ্ট পুলিশ ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হয়। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযুক্ত কনটেন্টের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য গ্রহণ ও কনটেন্ট ডিলিটের জন্য রিপোর্ট করা হয়।

তবে দেখা যায়, প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানের পর অভিযুক্তদের শনাক্ত করা সম্ভব হলেও অধিকাংশ ভুক্তভোগী পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ হিসেবে মামলা প্রক্রিয়ায় যেতে আগ্রহী হননি। তারা শুধু আইডি বন্ধ করে কিংবা কনটেন্ট ডিলিটের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ আইনগত ব্যবস্থা হিসেবে জিডি বা মামলা করেছেন, যার মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্ত করার পর অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

অভিযুক্তকে শনাক্ত করার পরও ভুক্তভোগীদের অনেকে মামলা করতে বা কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে চান না। এর প্রধান কারণ সহজে অনুমেয়, আমাদের জানা। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অভিভাবক ও পরিবারকে জানাতে না চাওয়া, লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়, আইনগত প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা না থাকা ও পরে আবার হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদি।

প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানের সময় ভুক্তভোগীরা তাদের সমস্যার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও প্রমাণ দিতে চান না। অনেকে তথ্য দিতে কালক্ষেপণ করেন। অনেকে যথাযথভাবে হয়রানির প্রমাণ দিতে পারেন না। তারা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি বন্ধ বা কনটেন্ট ডিলিট করতে বেশি আগ্রহী থাকেন। সাইবার অপরাধ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অভিযুক্ত আইডির বিষয়ে সব সময়ে তথ্য পাওয়া যায় না, যা সাইবার অপরাধ তদন্তের অন্যতম সূত্র।

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে পরিচয় লুকিয়ে অপরাধ করার কারণে অভিযুক্তের অবস্থান শনাক্ত করা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা দেশের বাইরে অবস্থান করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধ করছে। এসব ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত মোট অভিযোগের মধ্য থেকে ৩৫২ জন অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়েছে যারা দেশের বাইরে অবস্থান করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে অপরাধমূলক কর্মকাø চালাচ্ছে।

প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অ্যাপসের ব্যবহার বাড়ছে। ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তার সুযোগ বেশি থাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অ্যাপস ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিচয় গোপন রেখে অপরাধ করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অপরাধী শনাক্তকরণ দিন দিন কঠিন থেকে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে। এ কারণে সাইবার স্পেসে নারীর হয়রানি রোধে ব্যক্তি সচেতনতার বিকল্প নেই। ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান, বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের তথ্য প্রকাশে সাবধান হতে হবে। সাইবার হয়রানির ধরন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং ভুক্তভোগী কীভাবে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, অপরাধের প্রমাণ কীভাবে রাখবেন ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব হলে সাইবার স্পেসে নারীর হয়রানি অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এ বিষয়ে সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।

কিন্তু সাইবার অপরাধে প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা ও সতর্কতা। দিনে দিনে পাল্লা দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও আমাদের অনেক ব্যবহারকারীর নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা নেই। এ কারণে নিজের অজান্তে অনেকেই অপরাধের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। ইন্টারনেটে অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তথ্য বা ব্যক্তিগত কন্টেন্ট শেয়ার করার বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ঠিক তেমনিভাবে সমাজ তথা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। ইন্টারনেট ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধ দমনে বাংলাদেশ পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতার পূর্ণ ব্যবহারের পাশাপাশি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাইবার অপরাধ দমনে বিশেষায়িত ইউনিট স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বেড়ে চলা সাইবার অপরাধ দমনে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রয়াস একান্ত প্রয়োজন।

ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) : ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ

মতামত