বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও এক পরিবারের স্মৃতিকথা

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও এক পরিবারের স্মৃতিকথা

ম ইশতিয়াক মাহমুদ

বায়ান্ন বছর আগে আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, ১১ বছরের এক শিশু ছিলাম। তা সত্ত্বেও ’৭১ সালের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই ভয়াবহ দিন ও একই সঙ্গে আমাদের জাতির মুক্তিসংগ্রাম, যুদ্ধ ও বিজয়ের বীরত্বগাথার অনেক কিছুই আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। রেলওয়ের কর্মকর্তা আমার বাবা মরহুম তাফাক্কুর হোসেনের কর্মস্থলের কারণে ১৯৭১ সালে আমরা চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করছিলাম। পলোগ্রাউন্ড মাঠের কাছে ও রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবের পূর্ব পাশের টিলার ওপরের একটি বাংলোতে আমরা থাকতাম । ২৫শে মার্চের দিবাগত রাতে শোবার ঘরের লাইট জ্বলানো থাকায় এবং আব্বার উত্তেজিত গলায় টেলিফোনে কথা বলার কারণে ঘুম ভেঙে যায়।

আব্বা টেলিফোন রেখে দিয়ে বলেন, তার সহকর্মী মোজাম্মেল চাচা ফোন করে জানিয়েছেন, রেলওয়ের সিগন্যালিং সিস্টেম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইন্টারসেপ্ট করেছে। এর কিছুক্ষণ পরই আমাদের সেজো ফুপা রেলওয়ে অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মকর্তা (মরহুম হোসেন আহমেদ) তার পুরো পরিবার নিয়ে কদমতলীর মোড়ের কাছের বাসা থেকে নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের বাসায় চলে আসেন। আগেই বলেছি, আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রাম শহরের পলোগ্রাউন্ড মাঠের কাছে একটি টিলার ওপর। সেই টিলার ওপর থেকে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের মাঠের কিছু অংশ দেখা যেত। পাকিস্তান আমলে কলেজিয়েট স্কুল ও কিছু সরকারি স্কুলে নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রদের ‘জুনিয়র ক্যাডেট কোর’ (জেসিসি) কর্মসূচির আওতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আর তাদের প্রশিক্ষণের জন্য রাইফেলের একটি অস্ত্রাগার ছিল চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। মার্চের মাঝামাঝি মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা কলেজিয়েট স্কুলের অস্ত্রাগার থেকে রাইফেল বের করে স্কুলের ধূলিধূসরিত মাঠে অস্ত্র-চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছে, সামরিক কায়দায় প্যারেড করেছে, আর জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করেছে।

২৭শে মার্চ রাতে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার ও মুক্তিকামী সাধারণ জনতার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। আমাদের টিলার নিচে মর্টার বসিয়ে সম্ভবত ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গোলা ছুড়ছিল। তবে ২৮ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা থেকে এসে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে সামনের দিকের অর্থাৎ শহরের দক্ষিণ দিকের পাহাড়গুলো দখল করে নেয়। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের টিলায় আসে। তারা কেবল জানতে চায়, আমরা হিন্দু না মসুলমান। মুসলমান জানার পর তারা জিগ্যেস করে আশপাশে হিন্দু আছে কি না। আমাদের প্রতিবেশী অবাঙালি রউফ চাচার মেজো ছেলে এজাজ ভাই উর্দুতে বলেন, টিলার নিচে ধোপারা হিন্দু। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর এক লোক বলে, একটু পরেই ওদের লাশ নিয়ে তোমাদের এখানে আসছি…যদিও ওরা আসার আগেই ধোপারা পালিয়ে গিয়েছিল।

পরের দিন ২৯শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের টিলায় আসে এবং সেখান থেকে নির্বিচারে গুলি করে আশপাশের মানুষকে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী টিলায় অবস্থিত পুরুষ সদস্য, প্রতিবেশী অবাঙালি রউফ চাচা, তার তিন ছেলেসহ (ফারুক ভাই, এজাজ ভাই ও ইমতিয়াজ ভাই) সবাইকে আলাদা করে বলে, তাদের ক্যাম্পে যেতে হবে। আমার ফুপার অনুরোধে পাকিস্তানি বাহিনী আমার ফুফাতো ভাই মিরাজ ও আমাকে ‘লাড়কা’ বলে ছেড়ে দেয়। সব পুরুষকে পাকিস্তানি বাহিনী পেটাতে পেটাতে তাদের স্থানীয় ক্যাম্প সিআরবি (চিটাগাং রেলওয়ে বিল্ডিং)-তে নিয়ে যায়। এর আনুমানিক দুই ঘণ্টা পর রউফ চাচা তার তিন ছেলেসহ ফিরে আসেন। এর কিছুক্ষণ পর আব্বা ও আমার বড় ভাই ফিরে আসেন। আমার সেজো ফুপা ও ফুপাতো দুই ভাই (মামুন ভাই ও মারুফ ভাই) ফিরে না আসায় সেই সময়ে আমার সেজো ফুপুর সে কী অসহায় কান্না!

এই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী টিলায় অবস্থানরত সবাইকে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুকুম জারি করে। আমি ১১ বছরের শিশু, এত বড় সুটকেস ৬০-৭০ সিঁড়ির টিলা থেকে কীভাবে নামিয়েছিলাম, তা আল্লাহই জানেন। আমরা সবাই এবার আমার ফুপুর কদমতলীর বাসায় আশ্রয় নিলাম। দুপুরে খাওয়া হলো না, রাতেও খেতে পারলাম না। বিদ্যুৎ-পানিবিহীন এক ভয়ংকর পরিবেশ। চারদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি, পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ বাবর থেকে দূরপাল্লা কামানের গোলায় কান পাতা দায়। রাত আর পার হয় না। ভোরে দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এর আরো কিছুটা পরে হঠাৎ বাসার মূল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সবাইএক সঙ্গে সেদিকে দৌড়ে গেলাম। আমার ফুপা, দুই ফুপাতো ভাই, আমাদের বাসায় আশ্রয় নেওয়া আরো ৮-৯ জন পুরুষ সবাই ফিরে এসেছেন। সবার পোশাক রক্তে লাল—গতকাল সারা দিন ও রাতে তাদের দিয়ে বহু মৃত দেহ টানানো হয়েছে। এদের মধ্যে মামুন ভাইয়ের পাজামা ও পাঞ্জাবি প্রায় পুরোটাই লাল ছিল—তিনি পরে বলেছিলেন, তাকে দিয়ে সাত-আটটি লাশ টানানো হয়েছিল।

তারা যা বললেন, তা সংক্ষেপে হলো, তারা অলৌকিকভাবেই বেঁচে এসেছেন। সিআরবি ক্যাম্পের কমান্ডার পাকিস্তানি আর্মির একজন মেজর সবাইকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে অন্য কোথায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে আটক সব বাঙালি জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করেন এবং সেই জামাতে ইমামতি করা আমার ফুপার (তিনি ব্রিটিশ আমলে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স ছিলেন) উর্দুতে করা হৃদয়স্পর্শী মোনাজাতের কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সুবেদার মেজরের মন নরম হয়ে গেলে তিনি সবাইকে ছেড়ে দেন এবং বলেন, কোনো দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে সবাই যেন এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

লেখক : মহাব্যবস্থাপক, সুশাসন ও জবাবদিহিতা, সোশ্যাল ডেভেলপমেণ্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির টিম মেম্বার

রাজনীতি