বিএনপির ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হয়েছে গত বুধবার। এসব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের কোনো সংহিসতা হয়নি। গত ২৫ মে গাজীপুর, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। গাজীপুর স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী এবং অন্য চার সিটিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী জয়লাভ করে। এই পাঁচ সিটি নির্বাচন বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিএনপিতেও। পাঁচ সিটিতে ভোট বর্জনে কী লাভ বা লোকসান হলো তা নিয়ে বিএনপির মধ্যেও আলোচনা পর্যালোচনা চলছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় মনে করেন, আমরা এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না- এটা আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। বিএনপি কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা জাতি ভালোভাবেই জানে। এই ভোট বর্জনে লাভ-লোকসান কতটুকু হলো- তার চেয়ে বড় কথা নৈতিক দিকে জাতির সামনে দলের অবস্থান ঠিক থাকল, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলকে এই সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়েছে। এটাকে দলের বড়
সফলতা বলে মনে করেন গয়েশ^চন্দ্র রায়, যা আগামী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, তাদের বর্জন এবং অংশ নিয়েও পরে ইসলামী আন্দোলনের ভোট থেকে সরে আসার বিষয়টি পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে সরকারসহ যারা সন্দিহান, তারাও বার্তা পেয়েছেন। তবে দলটির নেতারা মনে করেন,
নির্বাচনে মেয়র পদে তাদের কোনো নেতা অংশ না নেওয়াটাই বড় সফলতা।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, পাঁচ সিটিতে বিএনপির ভোট বর্জনে লাভ হয়েছে, আবার লোকসানও হয়েছে। লোকসানের চেয়ে লাভই বেশি হয়েছে। এই ভোট বর্জনে জনগণের মধ্যে একটি স্পষ্ট বার্তা গেছে- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। বরং চলমান আন্দোলন আরও কঠোর হচ্ছে- সেই বার্তা দেওয়া হয়েছে।
গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির ঘোষণার পরদিন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট হয়েছে। বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন, সেখানে সুষ্ঠু ভোট হওয়ার কারণে নৌকাপ্রতীকের মেয়রপ্রার্থী পরাজিত হয়েছে। বিএনপি ভোট বর্জন করায় বাকি চার সিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়নি, যদিও একমাত্র বরিশালে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সেখানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়রপ্রার্থীকে মারধর করাসহ নানা অভিযোগ করে দলটি। এ ঘটনাকে কেন্দ্র এই দলটিও পরে রাজশাহী ও সিলেটের ভোট বর্জন করে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বিএনপির সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করেছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, এই নির্বাচনগুলোতে কত শতাংশ ভোটার মাঠে ছিল বা ভোট দিয়েছে- তা খোঁজ নিয়ে দেখবেন। বিএনপিকে সমর্থন জানিয়ে বড় অংশই ভোট দিতে যায়নি। এটা আমাদের বড় সফলতা। শুধু বিএনপি নয়, দেশের ডান, বামসহ গণতন্ত্রমনা সব রাজনৈতিক দল এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে। সর্বশেষ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে দলের নেতাদের আরেকটি মূল্যায়ন হচ্ছে, পাঁচ সিটিতে ভোট বর্জনে লাভের পরিমাণ বেশি হলেও দলটির লোকসানও কম হয়নি। দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে প্রয়োগ করায় বিএনপির একটি অংশ চুপ হয়ে যান। কিন্তু যারা নির্বাচনে অংশ নেন, তাদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এই নির্বাচনে যারা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন, সেসব নেতাদেরও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পাঁচ সিটি নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হওয়ায় শতাধিক নেতাকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরে ২৯ জন, বরিশালে ১৯ জন, খুলনায় ৯ জন, সিলেটে ৪৩ জন এবং রাজশাহীতে ১৬ জন নেতাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এদের বাইরেও যারা এসব প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কাজ করছেন তাদেরও বহিষ্কার করা হয়েছে। বিগত দিনে এসব নেতাদের আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এই বহিষ্কারের ফলে দল তাদের আগামী দিনের আন্দোলনে পাচ্ছে না-এটা স্পষ্ট হয়েছে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, পাঁচ সিটিতে দলীয় পদে থাকা কোনো মেয়রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেননি। এটা দলের জন্য বড় সফলতা। আবার যারা কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, এর পেছনেও নানা কারণ ছিল। কেউ কেউ মনে করেছেন, নির্বাচন না করলে এলাকায় তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ঠিক থাকবে না।
গুরুত্বপূর্ণ আরেক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, আরিফুল হক চৌধুরীর সিলেটে মেয়রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার কথা ছিল। কিন্তু তাকে ভাইস চেয়ারম্যান করা হবে-এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে থামানো হয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি দলে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ দলের সিদ্ধান্ত মেনে বরিশালের মজিবর রহমান সরোয়ার, রাজশাহীর মিজানুর রহমান মিনু ও মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জু এবং মনিরুজ্জামান মনি নির্বাচন করেননি। সেক্ষেত্রে তাদেরকেও ভাইস চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব উঠবে। এই সমস্যার সমাধান আগামীতে কীভাবে করা হবে, সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, জাতীয় রাজনীতি, আগামী নির্বাচন, দলের নেতাকর্মীদের আনুগত্য এবং দলের তৃণমূল সম্পর্কে বেশকিছু ধারণা পেয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এ বিষয়ে বিশদ মূল্যায়ন করতে গিয়ে তারা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। নানা প্রলোভন উপেক্ষা করে যারা নির্বাচন বর্জন করেছেন, তাদের আনুগত্যতা সম্পর্কে দল অবগত হয়েছে। ভবিষ্যতে দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে, সেখানে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, কেউ দলের ঊর্ধ্বে নয়। শৃঙ্খলা সবাইকে মানতেই হবে। কাউন্সিলর নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হলেও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কী হতে পারে- সে বার্তা এই নির্বাচনের মাধ্যমে নেতাকর্মীরা পেয়েছেন।