সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে নেই অভিযোগ-অনুযোগ অতিরিক্ত গতিই এখন যাত্রীদের ভয়
বিভিন্ন স্থানে যানবাহনের চাপ থাকলেও নেই যানজট ভোগান্তি
পশুর হাট কিংবা বিশেষ কারণে কোথাও কোথাও যান চলাচলে ধীরগতি
নৌপথের চাপেও স্বস্তি, রেলে ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’
‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’ চালকদের সচেতন করতে মন্ত্রণালয়ের ক্ষুদে বার্তা
অতীতে ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষদের যেভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হতো, এবার দু-একটি সড়ক-মহাসড়কে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া ভোগান্তিহীন ঈদযাত্রা করছেন ঘরমুখো মানুষরা। তবে যানজটের ভোগান্তি কমলেও যাত্রী মধ্যে চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। সাম্প্রতিককালে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় উঠে এসেছে নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রমের কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। উন্নত সড়ক-মহাসড়ক, লেন নির্ধারণ করে দেয়ার পরও চালকদের বেপরোয়া মনোভাব কিংবা অসচেতনতার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে— এমনটি আলোচনার মধ্যেই মূলত স্বস্তির মহাসড়কেও যাত্রীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকেও দেশের প্রত্যেক মোবাইল ব্যবহারকারীর হ্যান্ডসেটে ‘গতিসীমা মেনে চলি সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’ উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছে। একই সাথে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও কাজ করছে।
গতকাল ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতুতে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপে গাড়ির দীর্ঘ সাড়ির সৃষ্টি হয়। এই সেতু দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের প্রায় ২২টি জেলার যানবাহন চলাচল করে। সাধারণ প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার গাড়ি চলাচল করে এই মহাসড়ক দিয়ে। ঈদের ছুটিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজারে। এত বিপুল সংখ্যক গাড়ির চাপে টোলপ্লাজা মাঝে মধ্যেই বন্ধ রাখতে হয়। ফলে গাড়ির সাড়ি দীর্ঘ হয়ে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। সেতু টোলপ্লাজা সূত্র জানায়, গত রোববার সকাল ৬টা থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে মোট যানবাহন পারাপার হয়েছে ২৯ হাজার ৮৫টি। আর টোল আদায় হয়েছে দুই কোটি ৬৫ লাখ ৮৯ হাজার ৩০০ টাকা। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বে পারাপার হয়েছে ১৪ হাজার ৯৭৬টি যানবাহন ও টোল আদায় হয় এক কোটি ২৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫০ টাকা এবং সেতু পশ্চিম অংশে যানবাহন পারাপার হয়েছে ১৪ হাজার ৮৮১টি ও টোল আদায় হয়েছে এক কোটি ৩৯ লাখ ৪৮ হাজার ১৫০ টাকা। এদিকে সময়ের সাথে সাথে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার দুই লেনের যানবাহন চলাচল করছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল পাভেল বলেন, ঈদে স্বাভাবিকের তুলনায় তিনগুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে। এ ছাড়াও গরুবাহী ট্রাক তো থাকছেই। সেতুর পশ্চিম পাশে গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চালাতে না পারায় সেতুর পূর্বদিকে যানজট হয়। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিকঠাক থাকলে যানজটে যাত্রীদের ভোগান্তি হবে না। আজ থেকে ঈদ যাত্রায় যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যানজট এড়াতে সেতু পূর্ব ও পশ্চিমে মোট ১৮টি বুথে টোল আদায় করা হচ্ছে।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানান, গত রোজার ঈদে মহাসড়কে এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত দুই লেনের সড়ক একমুখী (ওয়ানওয়ে) করে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী যানবাহন এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর দিকে যেত। অপরদিকে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকামুখী যানবাহন সেতু পার হয়ে ভূঞাপুর লিংক রোড ব্যবহার করে এলেঙ্গা হয়ে ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এতে মহাসড়কে গাড়ির চাপ কমে অনেকটা সুফল মিলেছিল। অনেক বছর পর গত ঈদুল ফিতরে মহাসড়কে যানজট হয়নি। এবারও মহাসড়কের ওই অংশটুকু যানবাহনের জন্য একমুখী করা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ থেকে বাস ভুঞাপুর লিংক রোড ব্যবহার করে এলেঙ্গা হয়ে ঢাকা পৌঁছাবে। আর গরুবাহী ট্রাক সেতু থেকে সরাসরি এলেঙ্গা হয়ে ঢাকা যাচ্ছে। আশা করছি গত ঈদুল ফিতরের মতো এবারও কোনো যানজট হবে না। ঈদে ঘরমুখী মানুষ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবে। তিনি বলেন, মহাসড়কে থ্রি হুইলারসহ ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। মহাসড়ক ও সেতুর উপর কোনো যানবাহন বিকল হলে তাৎক্ষণিক সেতু কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের রেকারের মাধ্যমে তা অপসারণ করা হবে। যানজট নিরসনে পুলিশ সর্বাত্মক কাজ করছে।
সাভারের সড়কগুলোতেও যানবাহনের চাপ ছিল দিনভর। নবীনগর-চন্দ্রা, আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের প্রতিটি পয়েন্টেই রয়েছে যানবাহনের চাপ। সেই সঙ্গে বাস স্ট্যান্ডগুলোতে ঘরমুখো যাত্রীদের ভিড় বেড়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার, হেমায়েতপুর, সাভার বাসস্ট্যান্ড, নবীনগর, নয়ারহাটসহ কয়েকটি পয়েন্টে রয়েছে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের আশুলিয়া, জিরাবো, জামগড়া ও বাইপাইলের সড়কগুলোতে রয়েছে একই চিত্র। এ ছাড়া নবীনগর-চন্দ্রা সড়কের পল্লীবিদ্যুৎ, ডিইপিজেড, শ্রীপুর ও জিরানীতেও রয়েছে যানবাহনের জটলা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সড়কগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মোতায়েন রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পরিবহনের চালকরা বলেন, সকাল থেকে যানবাহনের চাপ বাড়তে শুরু করে। দুপুরের পর থেকে আরও বেশি যানবাহন সড়কে নেমে গেছে। গাবতলী থেকে বাইপাইল আসতে প্রতিটি স্ট্যান্ডেই ছিল যানবাহনের ধীরগতি। রাতে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। ঢাকা জেলা উত্তর ট্রাফিক ইনচার্জ (টিআই) জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা সড়কে আছি। সকাল থেকে পরিবহন বা যাত্রীর তেমন চাপ ছিল না। দুপুরের পর থেকে ধীরে ধীরে যাত্রীর চাপ ও যানবাহন বাড়তে শুরু করেছে। রাতে এই চাপ আরও বাড়বে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর হাটের কারণে যানজট ভোগান্তি না হলেও দীঘর্ঘ সাড়ির সৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল গাবতলীতে একদিকে গরুর হাট অন্যদিকে বাস টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের কারণে সড়কে চাপ বাড়তে দেকা যায়। যান চলাচলে সৃষ্টি হয় ধীরগতি। গাবতলী দিয়ে রাজধানী ছাড়তে কিংবা ঢুকতে সিগন্যালের কারণে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লেগেছে। যা এই গরমে বেশ ভোগান্তিতে ফেলেছে চলাচলকারীদের। তবে চিরায়ত যানজটের মহাসড়ক ঢাকা-চট্টগ্রামে গতকাল যানজটের অস্তিত্ব মেলেনি। স্বাভাবিক ছিল চলাচল। তবে মহাসড়কের বাজারগুলোতে ধীরগতি হলেও যানজটে পড়তে হয়নি বলে জানিয়েছে গাড়ির চালক ও যাত্রীরা। এই মহাসড়কে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন রাখতে হাইওয়ে পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘দাউদকান্দিতে যানজট নেই। টোলপ্লাজা এলাকায় আমাদের সতর্ক নজরদারি আছে। সেখানে আলাদা ফোর্স দেয়া হয়েছে। কুমিল্লার প্রবেশপথ ঢাকা, এখানে কোনো যানজট নেই। আমরা আশাবাদী কোনো যানজট হবে না।’
একইভাবে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতেও যানজট ভোগান্তির কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। অতীতে মাওয়া ঘাটে যেভাবে যানবাহনের দীর্ঘ সারি সৃষ্টি হতো তার প্রভাব নেই এবার। তবে এই মহাসড়ক ব্যবহারকারী যাত্রীরাই সবচেয়ে বেশি গতির ভীতি নিয়ে যাত্রা করছেন বলে জানা গেছে। যাত্রীদের অনেকেই বলছেন, এ মহাসড়কে চালকরা নির্ধারিত গতিসীমা মানছেন না।
নৌপথেও ঘরমুখো মানুষের চাপ ছিল গতকাল। যা সন্ধ্যার পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এর আগে দুুপুরের দিকেই রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাটে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে। যদিও অতীতের ন্যায় ভোগান্তি চিত্র দেখা যায়নি। রেলপথেও ছিল একই অবস্থা। আমাদের মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার রহমত উল্লাহ সরেজমিন ঘুরে জানান, অতীতে যেখানে কমলাপুর স্টেশনে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হতো তিন রাত তিন দিন। এবার টিকিটের সেই অপেক্ষার ইতি টেনেছে অনলাইন কার্যক্রম। যাত্রীরা হাতের মুঠেই পেয়েছে টিকিট। দূর হয়েছে টিকিট কালোবাজারির শঙ্কা। স্টেশনে জোরদার করা হয়েছে চেকিং পদ্ধতি। র্যাব, পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্কাউটের সদস্যরাও নিয়োজিত রয়েছে নিরাপত্তায়। টিকিট যার ভ্রমণ তার স্লোগানও প্রায় শতভাগ নিশ্চিত করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।