বিএনপি আসবে না ধরেই ইসির ‘সুষ্ঠু’ ভোটের প্রস্তুতি

বিএনপি আসবে না ধরেই ইসির ‘সুষ্ঠু’ ভোটের প্রস্তুতি

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসবে না– এমনটা ধরে নিয়েই ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ ভোটের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। সংবিধান নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন আয়োজনে সরকার বদ্ধপরিকর– ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। ফলে জোরেশোরে প্রস্তুতি শুরু করেছে কমিশন।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মকর্তারা বলছেন, অংশগ্রহণমূলক না হলেও নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন। সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেছে। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, বর্তমান কমিশন সরকারের হয়ে কাজ করবে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, সাংবিধানিক নির্দেশনা মেনে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইসি কার্যালয়ের সচিব জাহাংগীর আলম গতকাল বুধবার বলেন, ‘নির্বাচনের টাইমলাইনের মধ্যে ইসি ঢুকে গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য কমিশন যখন যে সিদ্ধান্ত দেবে, সে অনুযায়ী সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে তারা কাজ করবেন।’

বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৯ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে। এই ৯০ দিনের গণনা শুরু হবে আগামী ১ নভেম্বর।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান জানিয়েছেন, ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। নভেম্বরে তপশিল ঘোষণা হবে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ হতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। নির্বাচনে অংশ নিতে দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বিষয়ে কমিশনের কোনো এখতিয়ার নেই। তবে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে কমিশন।

ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণত তপশিল ঘোষণার পরে কমিশন সদস্যরা মাঠ প্রশাসনকে নিয়ে বড় পরিসরে বৈঠকের আয়োজন করে। এবার তপশিলের আগেই প্রশিক্ষণের নামে মাঠ প্রশাসনকে বিশেষ বার্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শুরুতেই ধাপে ধাপে বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, ডিসি, পুলিশ সুপার ও ইউএনওদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে চিঠি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে মাঠ প্রশসানকে ভোটের আবহে নিয়ে আসার চেষ্টা থাকবে।

আওয়ামী লীগের তৎপরতা

আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, গত মে-জুনে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটির ভোট বিএনপি বর্জন করলেও ওই নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক হয়নি। সংসদ থেকে বিএনপির পদত্যাগের কারণে শূন্য আসনের উপনির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কম হলেও নির্বাচন ছিল সুষ্ঠু। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল আবদুস সাত্তারের মতো অনেক বিএনপি নেতাই এখন এমপি হতে আগ্রহী। বিএনপি সরাসরি অংশ না নিলেও এমন নেতাদের নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে তারা মনে করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মিত্র ও ইসলামপন্থি দলগুলোকেও আলাদাভাবে ভোটে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। সম্প্রতি ইসির নিবন্ধন পাওয়া দল তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম এবং বিএসপি নিয়েও বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। দীর্ঘদিন সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির অনেক নেতাই নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী বলে মনে করা হচ্ছে। এই নেতাদের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে সরব করারও পরিকল্পনা রয়েছে।

বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিএনপির অপেক্ষায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। নিশ্চয়ই তারা এক পর্যায়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবে। ‘মরিবার আগে জ্বলে উঠলেও’ আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি তাদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। তিনি বলেন, বিএনপি না এলেও নির্বাচন হবে। তবে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন তিনি।

সম্প্রতি বিএনপির দুই সাবেক নেতার তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে গতকাল ঢাকায় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, এমন আরও অনেক নেতা বিএনপি ছেড়ে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেবেন। তিনি এ জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে বললেও কারা আসতে পারেন, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেছেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের দল। বিএনপিও নির্বাচনে আসবে। তারা নিজেদের প্রার্থী বাছাই করছে। কোনো কারণে বিএনপি না এলেও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সংলাপের উদ্যোগ নেবেন কিনা– এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপি চাইলে বক্তব্য শোনা যাবে, এতে বাধা নেই। তবে কোনো শর্তে নয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর  বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দল আন্দোলন করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই ভোটারবিহীন সরকারের অবৈধ নির্বাচন কমিশন আবার একতরফা নির্বাচনের কী প্রস্তুতি নিল, তাতে কিছু যায়-আসে না। দেশের জনগণ আবার বিতর্কিত কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না এবং হতেও দেবে না। জনগণ গণআন্দোলনের মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোটের অধিকার ছিনিয়ে আনবে। তৃণমূল বিএনপিতে তাদের দলের সাবেক দুই নেতার যোগদান নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা বহু আগে থেকেই বিএনপিতে নেই। তারা নতুন দলে যোগদানে বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না। সাগর থেকে দু-এক ফোঁটা পানি তুললে যেমন কিছু যায়-আসে না, তেমনি বিএনপিরও কিছু হবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবেন না– এটা তাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। চলমান আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের পর নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনেই তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন। সুতরাং এই সরকার ও নির্বাচন কমিশন কী করল, কীভাবে নির্বাচনের আয়োজন করবে– তা নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথা নেই, জনগণের মধ্যেও কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।

ইসির প্রস্তুতি

ইসি-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট বিতর্ক এড়াতে সাবধানে পা ফেলতে চাইছে কমিশন। নির্বাচন ঘিরে সম্প্রতি মাঠ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা বিতর্কিত মন্তব্য করায় এ বিষয়ে সতর্ক ও তৎপর হয়েছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। ইসির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে জামালপুরের ডিসিকে প্রত্যাহারও করা হয়েছে। একই সঙ্গে অন্য কর্মকর্তাদের সতর্ক করতে মন্ত্রিপরিষদকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদিও এর আগে ইসির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, তপশিল ঘোষণার আগে তাদের কিছুই করার নেই।

মাঠ প্রশাসনকে আগেভাগেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি কার্যালয়ের সচিব জাহাংগীর আলম গতকাল বলেন, সংসদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা কে হবেন, তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তপশিলের সিদ্ধান্তও হয়নি। কমিশন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। ডিসেম্বরের শেষ অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণ হবে। নির্বাচন বিতর্কমুক্ত রাখতে ইসির বার্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি পত্র দেওয়া হয়েছে। তারা মাঠ পর্যায়ে এটি জানাবে।

ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচন সামনে রেখে অনেক আগে থেকেই দাপ্তরিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নির্বাচনের রুটিন প্রস্তুতি দ্রুতগতিতেই চলছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। নির্বাচনী আইনে সংশোধনীর কাজও হয়ে গেছে।

মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণের কারণ ও ধরন সম্পর্কে ইসি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আইন ও বিধির সংশোধন, হালনাগাদ তথ্য অবহিতকরণ এবং সার্বিক নির্দেশনা দিতে এ আয়োজন করা হচ্ছে। বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, ডিসি, এসপি, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের ৯টি ব্যাচে ৭ থেকে ২২ অক্টোবর দুই দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের ৪১টি ব্যাচে চলতি মাসের শেষ বা আগামী মাসের শুরুতে প্রশিক্ষণ শুরু হবে। এ প্রশিক্ষণে সিইসিসহ কমিশনের সদস্যরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। মাঠ প্রশাসনের বর্তমান কর্মকর্তাদের বড় অংশই আগামী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে– এটি ধরে নিয়েই প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে।

ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ইতোমধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ হয়েছে, ১০টি নির্বাচনী এলাকা পুনর্গঠন করা হয়েছে, ৪২ হাজার ৩৫০টি ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ৬৬টি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং ইতোমধ্যে অনুমোদিত পর্যবেক্ষকের সংখ্যা কম মনে হওয়ায় আগ্রহী আরও সংস্থাকে আবেদনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের অনুমোদন দিতে কমিশন পূর্বপরিকল্পনা থেকে সরে এসে নীতি পরিবর্তন করছে এবং তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কমিশন ব্যালট পেপার, মনোনয়নপত্র এবং অন্যান্য উপকরণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, সিল, স্ট্যাম্প প্যাড, অমোচনীয় কালির কলম, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিলসহ নির্বাচনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার প্রক্রিয়া চলতি মাসে শুরু হয়ে নভেম্বরের মধ্যে শেষ হবে।

এসব প্রস্তুতির বিষয়ে ইসি সচিব জাহাংগীর আলম বলেন, ইসির পথনির্দেশনা অনুযায়ী ভোটের প্রস্তুতি এগিয়ে যাচ্ছে। প্রশিক্ষক তৈরির প্রশিক্ষণ চলছে। গত ২ সেপ্টেম্বর তা শুরু হয়েছে। তারা ১০ লাখ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেবেন। তিনি আরও বলেন, ইউএনও, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ সুপার, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, পুলিশ কমিশনারদের প্রশিক্ষণ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে শুরু হবে। চার ব্যাচে ১০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, এসব প্রশিক্ষণে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা, আইন সংশোধন ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত করা হবে।

রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ