: ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ নয় শান্তি চায়,’ মর্মে দেশের পররাষ্ট্র নীতির পুনরোল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে প্রতিঘাত করার মত সক্ষমতা অর্জনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই,’ কিন্তু কেউ যদি আমাদের সার্বভৌমত্বে আঘাত করতে আসে, প্রতিঘাত করবার মত সক্ষমতা যেন আমরা অর্জন করতে পারি-সেভাবেই আমাদের প্রশিক্ষণ এবং প্রস্তুতি থাকতে হবে। এ বিষয়টি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সবসময় মনে রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে মিরপুর সেনানিবাসের শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সে, ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স (এনডিসি)-২০২০ এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স (এএফডব্লিউসি)-২০২০ এর গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আমাদের দেশে তাদের প্রায় ১০ লাখের ওপরে নাগরিক আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের (মিয়ানমার) সঙ্গে কখনও সংঘাতে যাইনি এবং আলোচনার মাধ্যমে এটা সমাধানের চেষ্টা করছি এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও সকলকে আমরা আহ্বান জানিয়েছি-এই যে বিশাল একটা বোঝা আমাদের ওপর রয়েছে-এটার যেন তারা দ্রুত সমাধান করেন।’
জাতির পিতার করে যাওয়া দেশের পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ এর পুনরোল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেছে। সব থেকে বড় কথা আমাদের দেশের উন্নতি করতে হবে। তার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে যেখানে এবং যাদের কাছ থেকে যতটুকু সহযোগিতা পাওয়া যায়, প্রযুক্তি জ্ঞান পাওয়া যায়, সেটুকু নিয়েই আমরা আমাদের দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই কথাটা মনে রাখতে হবে, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমরা রাখবো।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিজের দেশের নিরাপত্তা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সশ¯্রবাহিনী সর্বদা প্রস্তুত থাকবে এবং আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি, সে কারণে সারা বিশে^ আজকে আমরা মর্যাদা পেয়েছি।’
তিনি বলেন, লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। এর সুফল বাংলার প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা পৌঁছে দিতে চাই।
চলমান মুজিববর্ষ থেকে আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনকালীন দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি ভূমিহীন, গৃহহীনকে অন্তত একটি করে ঘর করে দেওয়ায় তাঁর সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সকলকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলার কথাাও পুনরুল্লেখ করেন।
ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কমানড্যান্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
আইএসপিআর’এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জানায়, এ বছর ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০২০ এ (এনডিসি) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩১ জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চার কমোডোর এবং একজন ক্যাপ্টেন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাঁচ জন এয়ার কমোডোর রয়েছেন। সশস্ত্র বাহিনী অফিসারদের পাশাপাশি দু’জন অতিরিক্ত সচিব, ১১ জন প্রশাসনের যুগ্ম সচিব এবং সিভিল সার্ভিসের অন্যান্য ক্যাডার, বিদেশি পরিষেবা থেকে একজন মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ পুলিশের দুইজন উপ-মহাপরিদর্শক এতে অংশ নিয়েছিলেন। ১২ টি বন্ধু দেশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল/কর্নেল এবং সমমানের পদমর্যাদার ২৫ জন সদস্যও অংশগ্রহণ করেন।
এ বছর আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্সে তিন জন কর্নেল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৩ জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, দু’জন ক্যাপ্টেন এবং ছয় জন কমান্ডার বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে সাত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এবং একজন উইং কমান্ডার অংশগ্রহণ করেন।
‘মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে’, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কাজেই এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদেরকে আপনারা গড়ে তুলবেন। যেন সব সময় জনগণের পাশে থেকে জনগণের কল্যাণে কাজ করেন।’
তিনি সব সময় দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর সময় নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে রেখেও আপনারা ব্যাপকভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেবা দিয়েছেন। সেজন্য সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা করার জাতির পিতার স্বপ্নের উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু একটি আধুনিক, সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে ১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করেন প্রতিরক্ষা নীতি। সেই নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আমরা সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করে তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করছি।
তিনি দীর্ঘ ২১বছর পর ’৯৬ সালে সরকারে এসেই ক্ষুদ্র পরিসরে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীর জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের উচ্চমানের প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষার কথা বিবেচেনা করে ১৯৯৮ সালে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’
নবীন গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯-এর একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে স্ব-স্ব কোর্স সম্পন্ন করে আপনারা আজকে স্ব-স্ব কর্মস্থলে যোগ দেবেন। আপনাদের জীবন সফল হোক, আমি সেটাই চাই।
তিনি বলেন, আমি আশাবাদি যে, এনডিসি তার প্রশিক্ষণে উচ্চমানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েটগণ আপনারা আপনাদের অর্জিত জ্ঞান, ইচ্ছা শক্তি এবং অঙ্গীকারকে সামনে রেখে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল, টেকসই, উন্নয়ন আত্মনির্ভরশীলতা পর্বোপরি গৌরবময় অবস্থানের দিকে নিয়ে যাবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা যেন কখনো ব্যর্থ না হয়। আমাদের দেশ যেন উন্নয়নের উচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়। সারা বিশে^র কাছে সব সময় আমরা যেন মাথা উঁচু করে বিজয়ী জাতি হিসেবে চলতে পারি।
তিনি বলেন,‘আপনারা যেখানেই যাবেন বিজয়ী জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা বোধ নিয়ে, আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে চলবেন।’
সরকারের ডিজিটাল কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এনডিসি বাংলাদেশে প্রথম উচ্চ প্রশিক্ষণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘এডুকেশন ফোর পয়েন্ট জিরো’ প্রবর্তন করেছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের মত বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্ব যখন প্রায় স্থবির, এ সময় এনডিসি ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইনে লেকচার এবং অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করে কোর্সসমূহ সফলভাবে সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
নানা প্রতিকূলতার মাঝেও অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে এনডিসি ও এএফডব্লি¬উসি কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন এবং পরিচালনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী কমান্ড্যান্ট এনডিসিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং পাশাপাশি, অন্যান্য সকল ফ্যাকাল্টি সদস্য, রিসোর্স পারসন এবং স্টাফ অফিসারদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেন এবং আগামী দিনে জাতীয় গর্ব এ প্রতিষ্ঠানের জন্য সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি বলেন, ন্যাশনাল ডিফে›স কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যা দেশ ও বিদেশের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মাঝে উচু স্তরের জ্ঞান শৈলীর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে। ন্যাশনাল ডিফে›স কলেজ তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।
আজ শুধু সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেই নয়, এনডিসি জাতীয় পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসামরিক পরিম-লেও সমাদৃত হচ্ছে। সরকারি উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তাগণ এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন, বলেন তিনি।
অন্যান্য বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে এনডিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৩৭টি বন্ধুপ্রতীম দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যগণ এনডিসিতে উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তীতে তাদের নিজ নিজ দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এনডিসিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আপনারা রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও জাতীয় নিরাপত্তাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন সমস্যা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন, যার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োগ নিঃসন্দেহে নিজ দেশের জাতীয় অগ্রগতির ধারাবাহিতকতাকে বেগবান করবে।’
প্রধানমন্ত্রী বিদেশি শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আপনারা অবশ্যই কোর্সে অমূল্য জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বাংলাদেশী সহযোগীদের সাথে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং পেশাদার সম্পর্কের বাইরে সামাজিক বন্ধন এবং বন্ধুত্ব অবশ্যই গড়ে উঠেছে।’
তিনি আরো আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, বিদেশি প্রশিক্ষণার্থীরা এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে তাদের হৃদয়ে বাংলাদেশ এবং এর জনগণের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা হৃদয়ে ধারণ করেছেন তা নিয়ে স্ব-স্ব কর্মস্থলে গিয়েও এই দেশের জন্য শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করবেন।