ঢাকা, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকতা পেশাকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহারের আহবান জানিয়ে বলেছেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে কখনও বালকসুলভভাবে ব্যবহার করা উচিত নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কিন্তু এটাকে বালখিল্যভাবে ব্যবহার করা উচিত নয় এবং সবারই এ ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত।’
দেশের জন্য কল্যাণজনক হবে এমন ভূমিকাই গণমাধ্যমের পালন করা উচিত, যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট হতে অসুস্থ, অস্বচ্ছল ও দুর্ঘটনাজনিত আহত ও নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের অনুকূলে আর্থিক অনুদানের চেক বিতরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন।
জাতির পিতা সাংবাদিকদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিশ্বাস করি স্বাধীনতা ভালো। তবে, এখানে একটা কথা আছে- স্বাধীনতা ভাল তবে তা বালকের জন্য নয়। কাজেই এ ধরনের বালখিল্য ব্যবহার যেন কেউ না করে সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, অন্তত গঠনমূলক দায়িত্বশীল ভূমিকাটা পালন করা যেটা দেশের কল্যাণের কাজে লাগবে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা, আমি আশা করি নিশ্চয়ই সেটা আপনারা অনুভব করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮-এর নির্বাচনে দিন বদলের যে অঙ্গীকার করেছিলাম, আমি মনে করি নিশ্চয়ই আপনারা এটা স্বীকার করবেন আজকে মানুষের দিন বদল হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে দেখার, জানার জন্য জীবনে যতরকম ঝুঁকি নেওয়ার নিয়েছি এবং সুযোগ পেলে কিভাবে করবো সেই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছি বলেই আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আজকে আমরা মহাকাশও জয় করেছি, সমুদ্র সীমানা ঠিক করেছি আবার স্থল সীমানা চুক্তির বাস্তবায়ন করেছি। যাই করেছি তাঁর শুরুটা করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এই সময়ে জাতির পিতার সাড়ে ৩ বছরের শাসনে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত প্রদেশকে একটি দেশ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি এত পরিমাণ কাজ তিনি সম্পাদন করেছেন যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী ।
জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করে যাওয়াই তাঁর কর্তব্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার পক্ষে, বিপক্ষে মিডিয়ায় কে কি লিখলো, না লিখলো আমি চিন্তা করি না। আমি চিন্তা করি আমি যে কাজটা করছি সেখানে নিজের আত্মবিশ্বাসটা আছে কি না, সঠিক করছি কি না, নিজের আত্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই আমি চলি।
গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকরা এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলের দু:স্থ জনগণের কথা, বিপন্ন জনমানুষের কথা তুলে আনেন ফলে সরকারের তাঁদের পাশে দাঁড়াতে সুবিধা হয়।
সকলের কথা বলার এবং মত প্রকাশের অধিকার থাকার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কথা বলার স্বাধীনতা এটা সকলেরই আছে। সংবাদপত্র, সাংবাদিকদের স্বাধীনতার কথায় আমরা সব সময় বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘এটা কেউ বলতে পারবে না যে কারো গলা টিপে ধরেছি, কারো মুখ টিপে ধরেছি অথবা কাউকে বাধা দিয়েছি- দেইনি, দেই না। বরং সাংবাদিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করা দরকার আমরা করেছি।’
অন্যান্য পেশাজীবীদের মত সাংবাদিক কল্যাণকে তাঁর সরকার অগ্রাধিকার দেয় উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, সাংবাদিক কল্যাণে তাঁর সরকার ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ স্থাপন করে এর অওতায় অসুস্থ, অস্বচ্ছল,আহত এবং নিহত সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অনুদান দিয়ে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে আরো ২০ কোটি টাকা অনুদান প্রদানের ঘোষণা দেন।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, তথ্য প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
তথ্য সচিব মো. আব্দুল মালেক অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের মহাপরিচালক শাহ আলমগীরও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
এছাড়া, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি (ডিইউজে) আবু জাফর সূর্য এবং সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরীও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে একটি টেলিভিশন এবং একটি রেডিও পেয়েছি। এরপর আমরা বেসরকারি খাতে টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দেই। সংবাদপত্র এবং রেডিও যে যেভাবে চেয়েছে আমরা অনুমোদন দিয়েছি। এর উদ্দেশ্য ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মানুষের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা, বলেন তিনি।
সরকার প্রধান বলেন, আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি সাংবাদিকদের জীবন কেমন। তাদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেতনেরও নিশ্চয়তা কম। এ কারণে, আমি নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করি।
সংবাদপত্র-টেলিভিশনে কখনো ভালো প্রচার পাননি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘হতে পারে সেখানে যারা মালিক হয়তো তাদের কারণে। তবে সাংবাদিকদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক সব সময় রয়েছে।’
সংবাদপত্রের সঙ্গে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন যে, ছাত্র জীবন থেকে জাতির পিতার সংবাদপত্রের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল। প্রথমে ইত্তেহাদ নামে একটা পত্রিকা, তার আগে ছিল মিল্লাত নামে একটা পত্রিকা। এরপর ইত্তেফাক বের হলো। তিনি কিন্তু সবসময় এসব পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নিজের হাতে ইত্তেফাক বিক্রি করার কাজও করেছেন এবং পূর্ববঙ্গের পক্ষ থেকে তিনি এসব পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন করতেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা তাঁর পিতার সম্পর্কে বলেন, তিনি যে সংবাদপত্রের লোক ছিলেন সেটা কিন্তু তাঁর আত্মজীবনীতে স্পষ্ট লেখা আছে। সেদিক থেকে আপনারা আমাকে যদি আপনাদের পরিবারের একজন মনে করেন আমি খুশি হবো।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সকালে এক কাপ চা ও একটি পত্রিকা যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষ রাখে না। টেলিভিশন বন্ধ রেখে সকালে পত্রিকা নিয়ে বসি। সব পত্রিকা যে পক্ষে লেখে, তা নয়। প্রয়োজনীয় সংবাদগুলো মার্ক করি। সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে বলি। সংবাদপত্র থেকে অনেক তথ্য পাই। দুর্গম জায়গার অনেক তথ্যও সংবাদপত্রে আসে। তাতে আমরা সহযোগিতা পাই। এ জন্য সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতাকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার পর এ দেশের মানুষের কথা বলার অধিকারটুকু পর্যন্ত হরণ করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, সব সামরিক শাসকেরই এই চরিত্রটা থাকে, তারা ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতিবিদদের গালি দেন এবং এরপর তারাই উর্দি খুলে রাজনীতিবিদ সেজে যান। যার কুফল ভোগ করেন দেশের আপামর জনসাধারণ। আর সুফল ভোগ করে তাদের সাথে যারা যোগ দিতে পারে সেই মুষ্টিমেয় একটা এলিট শ্রেণি। সেটাই ছিল বাংলাদেশের ভাগ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিন্তু স্বাধীনতার সুফল কিন্তু তখনও মানুষের দ্বারে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ, তখনকার ক্ষমতাসীনরা আমাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল, স্বাধীনতার বিরোধিতা করাই ছিল তাদের কাজ। যার ফলে বাংলাদেশের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড যেগুলো দেশ স্বাধীনের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে জাতির পিতা শুরু করেছিলেন সেসব বন্ধ হয়ে যায়।
সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের প্রতি জাতির পিতার আন্তরিকতার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘আপনারা জানেন, স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানীরা পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর সমস্ত সাংবাদিককে কিন্তু সরকারি চাকরির মর্যাদা দিয়ে ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন জাতির জনক। তাদের অনেককে সরকারি চাকরি দিয়েছিলেন। এই সুযোগ দেয়ার জন্য একটি কমিটিও করা হয়েছিল। যদিও সেই কমিটির সদস্যরা পঁচাত্তরের পর সবচেয়ে বড় সমালোচক হয়েছিল।’
আবাসন সমস্যা নিয়ে সাংবাদিক নেতাদের সহযোগিতা চাওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে আবাসনের সমস্যার কথা উঠেছে। বিষয়টি আমি জানি। আমি যখন ন্যাম ফ্ল্যাট করেছি তখন বলেছিলাম কিছু ফ্ল্যাট থাকবে যেটা হায়ার পারচেজে সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক তারা নিতে পারবেন। যে কোন কারণেই সেটা আর হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন কিছু ফ্ল্যাট করছি যেটা সামান্য টাকা দিয়ে, যেটা কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করে এই ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারবেন। যারা চান তারা হতে পারবেন। ভাড়া থেকেই মূল্যটা পরিষদ হবে। প্রতি মাসে ভাড়া হিসেবে যেটা হবে সেটা মূল্য হিসেবে ধরা হবে। সেভাবে আমরা ফ্ল্যাট দিতে পারবো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্লট দেওয়া হয়েছে, তখন সাংবাদিকদের অনেকে পেয়েছেন। এখন মনে হচ্ছে ওভাবে প্লট না দিয়ে আমরা যদি ক্লাস্টার করে দিয়ে দিতাম। অনেকে মিলে হয়তো বাড়ি করতে পারতো।’
অনুষ্ঠানে মোট ১১৩ জনের মাঝে অনুদানের চেক বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।