আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে বাদ পড়ছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে ১২০ সংসদ সদস্য। তবে এই ১২০ আসনে বিগত নির্বাচনে বঞ্চিতরা পাবেন দলীয় মনোনয়ন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ১৪ দল থেকেও এবার নৌকার টিকেটের হার বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ১৪ দল থেকে বিগত দিনে যারা নৌকার টিকেট পাননি তাদের মূল্যায়ন করা হবে। এর মধ্যে বেশিরভাগই থাকবে নতুন মুখ।
সূত্র বলছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলটি দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। দলটি মনে করে, টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় থাকায় দলের অনেক সংসদ সদস্যই দলীয় শৃঙ্খলার কথা ভুলে গেছেন। বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। ফলে তারা এখন আর আওয়ামী লীগ আছে বলে মনে করেন না। তাদের অনেকেই স্থানীয় পর্যায়ে দেখান দাম্ভিকতা। এতে করে চটেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২ সেপ্টেম্বর গণভবনে ডাক পড়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতার। তারা রাত সাড়ে ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত গণভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।
তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এবার নির্বাচন হবে অত্যন্ত কঠিন। বিগত সময়ে যেমন নির্বাচন হয়েছে, তার চেয়ে এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। তাই এবার দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে অনেক কিছু বিবেচনা করা হবে। অনেকের আমলনামা আমার কাছে এসেছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১২০ জনকে বাদ দেওয়ার চিন্তা করছি। এদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, অর্থনৈতিক অনিয়ম, মালিকানা জমি দখল, সরকারি সম্পত্তি দখল, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তাদের এবার দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। তাদের এবার কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তারা দলে আছে, দলে থাকবে। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। এর মধ্যে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীও রয়েছেন। তাই কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোটকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে যারা যোগ্য তাদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমি চিন্তা করছি।
গত ২ সেপ্টেম্বর গণভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে উপস্থিত কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম এক নেতা বলেন, হঠাৎ করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধনের পর নেত্রীর এসএমএস পেলাম তার সঙ্গে দেখা করার। আমি দ্রুততার সঙ্গে চলে যাই গণভবনে। গণভবনে রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। শেখ হাসিনা বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে হবে। তবে এবারের নির্বাচন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে। সামনে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ১৪ দলের বিকল্প নেই। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপি-জামায়াতকে মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যার যার অবস্থান থেকে সরকারের উন্নয়ন প্রচার চালাতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে। ১৪ দলের অনেকেই গত তিন দফায় ক্ষমতায় থাকলেও কিছু পাননি। এবার ১৪ দলের যারা যোগ্য তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। ১৪ দলের সঙ্গে আরও ৮টি দল যুক্ত হবে। তবে ১৪ দলের নাম ১৪ দলই থাকবে। তারাও নির্বাচনে অংশ নেবে। তাদের মধ্যেও কেউ কেউ মনোনয়ন পাবেন। আপনারা হতাশ হবেন না।
অন্যদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, দফতর, উপ-দফতর, প্রচার, উপ-প্রচার সম্পাদকদের সঙ্গে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ বৈঠকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের অনেকেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুর, উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান কেউই সংসদ সদস্য নন। তাদের আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলে আশ্বস্ত করেছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের যার যার নির্বাচনি এলাকায় গিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে বিদেশে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে গুজব। ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর গণভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন আমরা পাইনি। গত ৬ সেপ্টেম্বর দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তার কাছে আমরা দুঃখের কথা বলেছি। তিনিও মন দিয়ে কথাগুলো শুনেছেন। তিনি আমাদের আশ^স্ত করেছেন, এবারের নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনা করবেন। আমরা তার কাছ থেকে দোয়া নিয়েছি। তিনি যার যার এলাকার নির্বাচনি মাঠে গিয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরাও ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি।
দেশে বর্তমানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যরাও আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তাদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দলের পাশাপাশি একাধিক সংস্থার মাধ্যমে জরিপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব জরিপে দলের সংসদ সদস্য-মন্ত্রীদের কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। জরিপে মূলত সংসদ সদস্য-মন্ত্রীদের এলাকায় অবস্থান, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক, দলের ত্যাগী ও পোড় খাওয়া নেতাদের সঠিক মূল্যায়ন করছেন কি না, নিজস্ব বলয় তৈরি করতে গিয়ে দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টিতে কোনো ভূমিকা রয়েছে কি না, দলের জন্য ভূমিকা কী ছিল, দখল ও অনিয়মের মতো বিতর্কিত কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত কি না, দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত কি না এমন বিষয়গুলো তুলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের এক এমপির বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলে পোড় খাওয়া নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে হাইব্রিডদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নিজের প্রভাব বিস্তার এবং দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মামলা দিয়ে অনেককেই জেল খাটানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত বছর জাতীয় সংসদের পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে কুমিল্লার এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। চাঁদপুরের এক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তাকে ডেকে মিলেমিশে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। নাটোরের দুই সংসদ সদস্যের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। নোয়াখালীর এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির দ্বন্দ্বও মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ ছাড়া ফরিদপুরের এক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বিষোদগারের অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরোধ এখন প্রকাশ্যে। সুনামগঞ্জের এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরোধ এখন চরম আকার ধারণ করেছে।
বরিশালের এক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, তার কর্মকা-ে খোদ উপজেলা আওয়ামী লীগ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। রাজশাহীর এক সংসদ সদস্য বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন একাধিকবার। পটুয়াখালীর এক সংসদ সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। ময়মনসিংহে একজন ও বরগুনার একজনের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বলেন, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর দলীয় মনোনয়ন কাকে দেওয়া হবে বা হবে না, তা একান্তই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক করবেন। এখানে কারও হাত নেই। তবে দলের মনোনয়ন বোর্ড রয়েছে। মনোনয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই নেত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন।