দেশে ভূমিকম্পে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা। এর প্রধান কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরব্যবস্থা। বুয়েটের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি ১৫০ বছর পরপর আমাদের এ অঞ্চলে সাত স্কেলের ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
পরবর্তীতে এই মাত্রার ভূমিকম্প খুব কাছাকাছি যে কোনো সময়ে ঘটতে পারে। সে হিসেবে ঢাকা বড় ধরনের ঝুঁকিতে আছে। ঢাকায় ভবন নির্মাণে কোনো ধরনের বিল্ডিং কোড তদারকি ছাড়াই হচ্ছে। ঢাকা শহরে ছয় লাখ ভবন আছে চারতলা বা তারও বেশি। আর ১০ তলা বা তার বেশি আছে দুই হাজার ১০০ ভবন। ছয় লাখের তুলনায় দুই হাজার ১০০ কিছুই নয়। ঢাকা শহরের ২৫ ভাগ ভবন ভূমিকম্পসহনীয়ভাবে তৈরি হয়নি।
শুধু তা-ই নয়, ভূমিকম্পে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ২০ শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ কংক্রিটের ভবন খুব বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ৩৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন রয়েছে মাঝারি ঝুঁকিতে। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে এসব ভবন ক্ষতির মুখে পড়বে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তুরস্কের মতো ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ৮০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হয়ে যাবে বলে গবেষকরা মনে করছেন।
গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী শহর ঢাকা। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে পাঁচ দশমিক তিন। অ্যানড্রয়েডের ভূমিকম্প সতর্কবার্তার তথ্যমতে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয় থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর গভীরতা ছিল ২৩ কিলোমিটার। তাছাড়াও গত ১৪ আগস্ট ও ১৭ সেপ্টেম্বর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঢাকাসহ তার পার্শ্ববর্তী এলাকা। যার উৎপত্তিস্থল ছিল টাঙ্গাইলে। এভাবে কিছুদিন পরপর ঢাকা কেঁপে উঠছে। তবে কম্পনের পরিমাণ কম থাকায় তেমন কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। যদি এখনই সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৮টি ওয়ার্ডে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা ভবনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যদি ভূমিকম্প দিনের বেলা হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের মৃত্যু তুলনামূলক বেশি হবে। কারণ, দিনে বিভিন্ন কারখানা ও বাণিজ্যিক ভবনে মানুষের উপস্থিতি বেশি থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ এসব ভবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশস্ত রাস্তাও নেই। ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায় এ বিষয়টিও বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঢাকায় ভূমিকম্প হলে এসব কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি। সম্প্রতি দ্য গ্লোবাল আর্থকোয়াক ষ এরপর পৃষ্ঠা ২ কলাম ১
ডিজাস্টার রিস্ক ইনডেক্স (ইডিআরআই)-এর এক তথ্যে উঠে এসেছে— ঢাকাকে বিশ্বের ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মধ্যে অন্যতম শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের আওতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওন ১৫২৮ বর্গকিমি এলাকায় পরীক্ষা করে জানা যায় যে, টাঙ্গাইলের মধুপুরে ছয় দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ঢাকায় আট লাখ ৬৫ হাজার ভবন (প্রায় ৪০.২৮ শতাংশ) ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবে দুই লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবে দুই লাখ ২৯ হাজার। ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় চার লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। আরও বলা হয়েছে, সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় সাত দশমিক এক মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি ভবন (১.৯১ শতাংশ) ধসে পড়বে। দিনের বেলায় ভূমিকম্পটি হলে ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আহত হবে ২৮ হাজার। এ মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার (সাড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা)।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকায় জনসংখ্যা ও ভবনের সংখ্যা আয়তনের তুলনায় বেশি হওয়ায় ঝুঁকিটা বেশি। অতীতেও এ দেশে প্রচুর ভূমিকম্প হয়েছে। গত চার-পাঁচ বছরে এতটা ভূমিকম্প হয়নি যতটা এ বছর হয়েছে। আবারও সাত স্কেলের ভূমিকম্প হতে পারে। আমাদের এ অঞ্চলে ১৫০ বছর পরপর এরকম ভূমিকম্প হয়। ঢাকা শহরে প্রায় পাঁচ লাখ পাকা দালান আছে। যার অধিকাংশ খুব বেশি ভালো নেই। রাজউক ও সিটি কর্পোরেশন এগুলোকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে এসব ভবন কতটা ঝুঁকিতে আছে।
ড. মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, রানা প্লাজা ধ্বংসের পর গার্মেন্টের ৩৫০০ ভবনে এই পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এভাবে ঢাকার প্রতিটি ভবনকে যাচাই করে দেখতে হবে। ঢাকায় ৩৫ শতাংশ দালান ভরাট করা মাটিতে তৈরি করা হয়েছে। সেসব স্থানে করা ভবনগুলো খুব বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। মাটি খারাপ হলে ভবন ভালো করলেও তেমন লাভ হবে না। তাই ভবন করার জন্য মাটিকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যদিও এ ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশন থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই; তবে রাজউক এ বিষয়ে একটি টিম গঠন করেছে।
তাছাড়া রাজউকের নিজস্ব কোনো সক্ষমতাও নেই পরিকল্পনা তৈরি করার ক্ষেত্রে। রাজউক শুধু বাহির থেকে দেখে ভালোমন্দ বলছে; কিন্তু ভবনের রড, কংক্রিট ও সার্বিক অবস্থা দেখে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। প্রকৃত কাজ করতে গেলে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। সাত মাত্রার ভূমিকম্প আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। যেটি প্রতি ১৫০ বছর পর হয়। তাছাড়া আট মাত্রার ভূমিকম্প প্রতি ৩০০ বছর পরপর হয়। ১৮৯৭ সালে সর্বশেষ আট স্কেলের ভূমিকম্প হয়েছিল; ফলে এটির সময় এখনো হয়নি। তবে সাত মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হতে পারে।