সবার মাথায় হাত, মালেকের বাজিমাত স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় ১৫% কমিশন মন্ত্রিপুত্র রাহাত মালেকের পেটে দুদকের হিসাবে জাহিদ মালেকের সম্পদ ১২২৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার অন্তত এক হাজার কোটি টাকা

সবার মাথায় হাত, মালেকের বাজিমাত স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় ১৫% কমিশন মন্ত্রিপুত্র রাহাত মালেকের পেটে দুদকের হিসাবে জাহিদ মালেকের সম্পদ ১২২৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার অন্তত এক হাজার কোটি টাকা

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাহিদ মালেক। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। শেখ হাসিনার আশীর্বাদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়ে যাঁর কপাল খুলে যায়! করোনার সময় যেখানে মানুষ আয়হীন-কর্মহীন, চরম আর্থিক দুর্দশায়; সেবা ও শিল্প খাত যখন মারাত্মক ক্ষতির মুখে তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ‘টাকার কুমির’ হয়ে ওঠেন। করোনার টিকা বাণিজ্য, টেস্ট কিট, নকল মাস্কের ভুয়া আমদানি, হাসপাতালের কেনাকাটা, ওষুধ ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও অবকাঠামো উন্নয়নকাজে বেপরোয়া অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে জাহিদ মালেক গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।

এর বাইরে জমি দখল, বালুমহাল, পরিবহন খাত ও নিয়োগ বাণিজ্যেও সমান পারদর্শী জাহিদ মালেক মন্ত্রিত্বকে ব্যবহার করেন টাকা বানানোর হাতিয়ার হিসেবে। অবৈধ টাকার বেশির ভাগই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বৈধভাবে ৬৮ কোটি টাকা থেকে রাতারাতি তিনি বনে যান এক হাজার ২২৪ কোটি টাকার মালিক। তিনি অন্তত এক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন জাহিদ মালেকের এই বিপুল সম্পদের উৎসর খোঁজে অনুসন্ধান করছে।
দুদক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জাহিদ মালেকের বিদেশে এক হাজার কোটি টাকা পাচার ও দেশে ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। অসাধু উপায়ে অর্জিত এসব সম্পদের বেশির ভাগেই তিনি নিজ নামে ও আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে বিদেশে পাচার করেছেন।

দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, অনুসন্ধান দল এ বিষয়ে দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহ করছেন।

প্রমাণাদি সংগ্রহ শেষে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপরই কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
জানা যায়, দুদক গত ১২ ডিসেম্বর জাহিদ মালেক ও তাঁর ছেলে রাহাত মালেকের বিরুদ্ধে মামলা করে। এতে বলা হয়েছে, অসাধু উপায়ে জাহিদ মালেক জ্ঞাত আয়ের উৎসবর্হিভূত ৬১ কোটি ৪২ লাখ ৫৬ হাজার টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জনপূর্বক ভোগদখলে রেখে ৩৪টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১৪৩ কোটি ১০ লাখ টাকা লেনদেন করেন, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেকের বিষয়ে দুদক জানায়, আয়ের উৎসবহির্ভূত ১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা সম্পদের মালিকানার পাশাপাশি তিনি ৫১টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ৬৬৩ কোটি ২৬ লাখ টাকার লেনদেন করেছেন।

পিতার সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত এই বিপুল অর্থ-সম্পদ অর্জন করেন তিনি।

ছয় হাজার ৫৩ শতাংশ জমি ক্রয়

জাহিদ মালেক ও তাঁর পরিবারের নামে থাকা ছয় হাজার ৫৩ শতাংশ জমির তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি জেলার সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে জাহিদ মালেক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিল সংস্থাটি। সেই চিঠির জবাবে তাঁদের নামে ছয় হাজার ৫৩ শতাংশ জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়।

দুদক সূত্র জানায়, মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন মৌজায় কেনা এসব জমির মধ্যে জাহিদ মালেকের নামেই রয়েছে ২১৯৩.০৫৩ শতাংশ। তাঁর ছেলে রাহাত মালেকের নামে ১৭৪২.০১৬ শতাংশ এবং ১১১৮.৭৮ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে মেয়ে সিনথিয়া মালেকের নামে। বিপুল পরিমাণ এই জমির বাজারমূল্যও টাকার অঙ্কে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এসব বিষয়ে জানতে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও তাঁর ছেলে রাহাত মালেকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করেও মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।

 

রাজনৈতিক সুবিধা বিতরণ করার অভিযোগ

গত ৭ মে প্রকাশিত স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কভিড-১৯ মহামারি চলাকালে কিছু হাসপাতালে প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামের দাম ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে অপ্রয়োজনীয় ও নিম্নমানের স্থাপনা তৈরি করে লুটপাট করা হয়েছে। নতুন ভবন নির্মাণেও ব্যয় করা হয়েছে অনেক বেশি। মন্ত্রণালয় নিজেই উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতির চাহিদা তৈরি করে অর্থ অপচয় করছে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্স অননুমোদিত অর্থের লেনদেন করা হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ২০২৪ সালের এক গবেষণায় তথ্য দিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করছে সংস্কার কমিশন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, গত ২৫ বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বাজেট বেড়ে যাওয়ায় প্রভাবশালী মহল নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে লবিং শুরু করে। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে এমনকি মন্ত্রী পর্যায়ে এসব সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক সুবিধা বিতরণ করার অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে নির্মাণের স্থান ও প্রকৃতি নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা ও ঠিকাদাররা প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে নিম্নমানের ও অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা তৈরি হয়। এভাবে নতুন স্থাপনার সংখ্যা বাড়লেও বিদ্যমানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ না থাকায় বহু প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও সংস্কার কমিশনের সদস্য আহমদ এহসানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈশ্বিক বিবেচনায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ সর্বনিম্নে। এই কম বরাদ্দের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি ও দুর্নীতির সমস্যা থাকলে সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে প্রান্তিক জনগণ। যে প্রান্তিক জনগণ অর্থ ও অন্যান্য নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। অর্থাৎ তারা বিনামূল্যে যে সেবাটুকু পেতে পারত, সেটা নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে।’

 

২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কভিড-১৯ করোনাকালে ৫১ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরকারি আইন ও বিধি না মেনে চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করে। ক্ষমতা ছাড়ার আগের তিন বছর চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহের কাজ পেতে প্রতিটি কম্পানিকে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়েছে। কমিশনের অর্থের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ নিয়েছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক শুভ্র।

অধিদপ্তরের কেনাকাটার নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সাল থেকে পরবর্তী তিন বছর মোট ৭২টি দরপত্রে ৩১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বেশি চিকিৎসা যন্ত্র কেনা হয়। ঘুরেফিরে ২৪টি প্রতিষ্ঠান এসব কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪২ কোটি ৮০ লাখ ৪৩ হাজার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১৯ কোটি ১০ লাখ ৮৮ হাজার এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৬ কোটি ৯৬ লাখ ২৭ হাজার টাকার যন্ত্র কেনা হয়।

কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য খাতের প্রভাবশালী ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর টেকনোক্র্যাট লিমিটেড কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হলে তিনি আত্মীয়স্বজনসহ নামে-বেনামে অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করেন।

গত তিন বছরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তাঁর ভাগ্নের প্রতিষ্ঠান ট্রেড হাউস ১১টি প্যাকেজে ৫১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। মিঠুর আরেক আত্মীয়র প্রতিষ্ঠান ওয়ান ট্রেড তিন প্যাকেজে পাঁচ কোটি ৮৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকার কাজ পেয়েছে। এ ছাড়া তাঁর অধীনে থাকা এমএস মাইক্রো ট্রেডার্স চার প্যাকেজে ১৭ কোটি ৬৪ লাখ, ছয় প্যাকেজে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস ১৭ কোটি সাত লাখ ও ৯ প্যাকেজে টেকনোওয়ার্থ অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড ১১ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, রাহাত মালেক শুভ্রর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় দীর্ঘদিন সক্রিয় ছিল দুষ্টচক্র। তাঁর সহযোগী ছিলেন অধিদপ্তরের সাবেক লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন। সরকার কিংবা বিরোধীদলীয় যেই হোক না কেন, শুভ্র-তপন চক্রকে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন না দিয়ে কেউ কাজ পাননি। শুধু তা-ই নয়; তাঁরা দুর্নীতি, প্রতারণার অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকেও কাজ দিয়েছেন। করোনাকালে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানের মালিকরা জালিয়াতির মাধ্যমে নাম বদলে এখনো ঠিকাদারিতে সক্রিয়। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেপ্তার হলেও দমেনি ব্যবসা।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ