গত মার্চের শুরুতে দেশে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হলে একের পর এক ক্রয়াদেশ হারাতে থাকেন তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারকরা। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে জুন মাস নাগাদ ক্রয়াদেশ ফিরে পেতে শুরু করেন তারা, যার প্রতিফলন ঘটে জুলাইয়ের রপ্তানি চিত্রে। কিন্তু প্রথম ঢেউয়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ফের আঘাত হেনেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, যার প্রভাবে এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ কমেছে তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশ। এই খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রথম ঢেউয়ের স্থবিরতা কাটিয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে উঠে রপ্তানি খাত। কিন্তু অক্টোবরেই দ্বিতীয় আঘাত শুরু হয়। মূলত পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় ক্রেতারা ক্রয়াদেশের লাগাম টেনে ধরতে শুরু করেছেন। শীতের মৌসুমকে কেন্দ্র করে ক্রয়াদেশ যেখানে বাড়ার কথা, সেখানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমেছে অন্তত ৩০ শতাংশ।
এদিকে বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি নভেম্বর মাসের ১ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পোশাক রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৯ সালের নভেম্বরের প্রথম ১৪ দিনে রপ্তানি হয়েছিল ১০৫ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের পোশাক। চলতি নভেম্বরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পোশাক। করোনার প্রভাব দেশের শিল্প খাতে স্পষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ, শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী শিল্পপণ্য আমদানি কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে এসব পণ্য আমদানির এলসি খোলার হার। শিল্প উৎপাদনও নিম্নমুখী।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের শিল্প খাতে আগামী দিনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যার প্রভাব দীর্ঘ হবে—এমন আশঙ্কা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল ১ হাজার ৪৬০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে ১ হাজার ৩৩০ কোটি ডলার। ঐ সময়ে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ।
গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের ঐ সময়ে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১৫০ কোটি ডলারের পণ্য। আলোচ্য সময়ে আমদানি কমেছে পৌনে ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে বেশির ভাগই কমেছে শিল্পসংশ্লিষ্ট উপকরণের আমদানি।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে সাড়ে ১৫ শতাংশ, একই সঙ্গে আমদানি কমেছে ৩৯ শতাংশ। অন্যান্য শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। আমদানি কমেছে সাড়ে ১৫ শতাংশের বেশি। নতুন শিল্প স্থাপনের গতি হ্রাস পাওয়ায় যন্ত্রপাতি আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে এলসি খোলার হারও।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় অর্থনীতির চাকা আবার থেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য নীতি নির্ধারণে আরো সতর্ক হওয়াসহ নতুন করে প্রণোদনা ঘোষণারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এখন কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে হবে। এ জন্য প্যাকেজ বাস্তবায়নে আরো নজর দিতে হবে। আর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নে একটি স্বাধীন মূল্যায়ন করতে হবে।
কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি রীতিমতো কাঁপছে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এক চীন ছাড়া সব বড় অর্থনীতিই সংকুচিত হয়েছে। চলতি বছর বিশ্বের ৭ কোটি থেকে ১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের শিকার হবেন। ১৯৯০ সালে বিশ্বজুড়ে চরম দরিদ্র মানুষ ছিল ২০০ কোটির মতো, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৬ শতাংশ। গত বছর সেই সংখ্যা নেমে এসেছিল ৬৩ কোটিতে, যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মাত্র।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সঙ্গে এক যৌথ গবেষণা শেষে জাতিসংঘ জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস মহামারিতে ৭০টি দেশের ৪৯ কোটি মানুষ দরিদ্র হচ্ছেন। যাদের বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ, পর্যাপ্ত খাবার নেই, সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর মতো পরিস্থিতি নেই। এর কারণে বিশ্ব অন্তত এক দশক পিছিয়ে যাবে। করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সম্ভবত জীবিকার জন্য শহরনির্ভর মানুষেরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক ধারণা জরিপ প্রতিবেদন বলছে কোভিড-১৯-এর প্রভাবে চলতি বছরের মার্চের তুলনায় আগস্টে দেশের পরিবারগুলোর গড় আয় কমেছে প্রায় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, প্রথম পর্যায়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউ লম্বা ও দীর্ঘ সময় থাকার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীত চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল করোনার প্রথম পর্যায়ের আক্রমণ। এ কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত মোকাবিলা করাটা কিছুটা কঠিন হবে বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।