গত দেড় বছরে কোভিডের অভিঘাতে তছনছ হয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। অনেক মানুষের কাজ গেছে। অনেক মানুষের আয় কমেছে। তবে সবচেয়ে বেশি কাজ গেছে তরুণ ও নারীদের। বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি ২৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে তরুণদের বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ২৫-এর বেশি বয়সী মানুষের বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
কাজ হারানোর পাশাপাশি অনেক মানুষ নিষ্ক্রিয় বসে আছেন। সে জন্য অর্থনীতিবিদেরা এ নিষ্ক্রিয় ও বেকার মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে থাকেন। যাঁরা এখন কাজে নেই, তবে কাজের খোঁজ করছেন, তাঁরা বেকার। অন্যদিকে যাঁরা সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছেন না বা নিজের ব্যবসা চালু করার অপেক্ষায় আছেন, তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হিসেবে বিবেচিত হন।
যাঁরা এখন কাজে নেই, তবে কাজের খোঁজ করছেন, তাঁরা বেকার। যাঁরা কাজ খুঁজছেন না বা ব্যবসা চালু করার অপেক্ষায় আছেন, তাঁরা নিষ্ক্রিয়
মহামারিতে মধ্য আয়ের দেশগুলোর তরুণেরা সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছেন। যেমন আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পেরু। এ দেশগুলোর অর্থনীতি পর্যটনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আর এ পর্যটন খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয় তরুণদের। স্বাভাবিকভাবে তাঁদের শরীরেই ধাক্কাটা বেশি লেগেছে। এ ছাড়া উন্নত দেশগুলোর মতো সক্ষমতা তাদের নেই। ফলে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন দিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের জন্য বড় অঙ্কের প্রণোদনা ঘোষণা করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
আইএলওর তথ্যে দেখা যায়, যেসব দেশে প্রণোদনা বা সরকারি সহায়তা কম দেওয়া হয়েছে, তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
তার মানে অবশ্য এই নয় যে উন্নত দেশের তরুণদের গায়ে আঁচ লাগেনি। ইউরোপের তরুণেরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। মহামারির শুরুতে স্পেন ও ইতালি ইউরোজোন সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। স্পেনের পুনরুদ্ধার কার্যক্রম উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির পক্ষে তরুণদের বেকারত্ব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। এসব দেশের সরকার বিপুল অঙ্কের প্রণোদনা দিয়েছে। এ টাকা দিয়ে অনুদান, ঋণ, সহায়তা সবই করা হয়েছে। যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়েছে, তাদের সহায়তা দিয়েছে সরকার। দিয়েছে করছাড়। কর্মীদের বেতনও দেওয়া হয়েছে এ টাকায়।
অন্য বড় অর্থনীতিগুলোতে দেখা গেছে, মহামারির শুরুর দিকে বেকারত্বের হার বাড়লেও সরকারি নীতি সহায়তার বদৌলতে তারা তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তরুণদের বেকারত্বের হার বাড়েনি। যুক্তরাষ্ট্রের লকডাউনের শুরুতে বিপুল মানুষ বেকার হয়ে পড়লেও পরবর্তীকালে ট্রাম্প ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজের কারণে বেকারত্বের হার আর বাড়েনি।
নারীদের বিপত্তি
দেখা গেছে, তরুণদের তুলনায় তরুণীদের জীবনে কোভিড-১৯-এর বেশি প্রভাব পড়েছে। কাজ তাঁদেরই বেশি গেছে। অংশত, পর্যটন খাতসহ যেসব খাত মহামারিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে, সেসব খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি হওয়া এর একটি কারণ। আইএলওর হিসাব অনুসারে, সারা বিশ্বের পর্যটন, হোটেল ও ক্যাটারিংয়ের ৫৫ শতাংশ কর্মী নারী। এ ছাড়া লকডাউনের মধ্যে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুদের দেখাশোনা ও পড়ানোর বাড়তি দায়িত্বও নারীকে পালন করতে হয়েছে। আইএলওর তথ্যে দেখা যায়, মধ্য আয়ের দেশগুলোতে পুরুষের বেকারত্বের হার যেখানে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রে তা ২৯ শতাংশ।
সংকটের সময় যারা স্কুল ছেড়ে যায় বা স্নাতক হয়, তারা কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে না। ক্রান্তিকালে সবারই লক্ষ্য থাকে খরচ কমানো। ফলে এই সময়ে তরুণেরা অভিজ্ঞদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। আবার পরবর্তী প্রজন্ম যখন আসে, তখনো তাঁরা নতুনদের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন।
দারিদ্র্য, অসমতা, কর্মসংস্থান
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেল, যারা প্রণোদনা বেশি দিয়েছে, তারা তরুণদের বেকারত্ব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরাও প্রণোদনার কথা বলে আসছেন। কিন্তু এযাবৎ যা দেওয়া হয়েছে তা পেয়েছেন মূলত বড় ব্যবসায়ীরা। সরকার সরাসরি ৩৫ লাখ গরিব মানুষকে নগদ সহায়তা দিয়েছে দুবার। তবে তা যথেষ্ট নয় বলেই অর্থনীতিবিদেরা বলছেন।
অন্যদিকে যাঁরা কাজ হারিয়েছেন বা যাঁদের আয় কমেছে, তাঁদের সরাসরি প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। দেশে তথ্য বা পরিসংখ্যানের ঘাটতি আছে বলে বেকারত্বের প্রকৃত হার কত, কারও পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। সানেম ও বিআইজিডি-পিপিআরসির জরিপে দেখা গেছে, গত ১৫ মাসে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে আড়াই থেকে সাড়ে তিন কোটি মানুষ। কিন্তু এবারের বাজেটে সেই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেনি বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ব্যবসাবান্ধব বলে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দেশি শিল্পের বিকাশে কিছু ছাড় দিয়েছেন তিনি। এতে কর্মসংস্থান হবে বলে আশাবাদ। কিন্তু চুইয়ে পড়ার এই নীতি যে এখন কার্যকর নয়, উন্নত দেশের অভিজ্ঞতাই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। যারা এ তত্ত্বের প্রবক্তা, তারাই এখন তা অনুসরণ করে না।
বাংলাদেশের অত প্রণোদনা দেওয়ার সক্ষমতা না থাকলেও বাস্তবতার অস্বীকৃতি থাকাটা সমীচীন নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।