দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, আজকে দেশের গণতন্ত্রের জন্য খালেদা জিয়া বন্দিজীবন যাপন করছেন। ৩৫ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা, পাঁচশর বেশি মানুষ গুম হয়ে গেছেন, শত শত মানুষ খুন হয়েছেন। এরা কিন্তু রাজনৈতিক নেতাকর্মী।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, এমনকি অনেক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে। তাহলে কোথায় গণতন্ত্র? আমাদের এখানে সবই আছে, এখানে সরকার আছে। জাতীয় সংসদ আছে, আমলাতন্ত্র আছে কিন্তু মানুষের অধিকার নেই।
এই অধিকার আদায়ের জন্য গণমাধ্যম অতীতের মতো সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, এখনকার সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র নেই। গনতন্ত্র না থাকলে গণমাধ্যমও ভালো থাকে না। সাংবাদিক আজ ভালো নেই। তারা খুব কষ্ঠের মধ্যে কাজ করছেন। সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের রক্ত ঝড়েছে। মাহমুদুর রহমান, যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমানসহ অনেক সাংবাদিককে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। ৪২ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন বর্তমান সরকারের আমলে। বিএফইউজের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজীসহ অনেকে কারাগারে আছেন। আবুল আসাদের মতো প্রবীণ সাংবাদিককেও তারা শুধু জেলে পুড়েন নি, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছেন। এটা ফ্যাসিজমের নিয়ম। প্রথমে তারা রাজনীতিকদের ধরেছে এরপর এখন সাংবাদিকসহ ভিন্নমত দমন শুরু করেছে।
রোববার সকালে ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন একাংশের উদ্যোগে ‘মহান স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী: গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এই ভার্চুয়াল আলোচনা সভা হয়।
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলেও আমাদের দেশে গণমাধ্যমের ক্রান্তিকাল চলছে। স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পরও আমাদের গণমাধ্যমগুলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। ক্ষমতার প্রভাব বলয় থেকেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সবকিছু। যতটুকু স্বাধীনতা দিলে ক্ষমতবানদের সমস্যা হয় না ততটুকুই স্বাধীনতাই ভোগ করছে সংবাদমাধ্যম। মূলত, দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি এবং সুশাসনের অনুপস্থিতির কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন ছিল বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আইনের শাসন,ন্যায়বিচার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বর্তমানে এর কোনোটিই কার্যকর নেই। মিডিয়ার স্বাধীনতা ততটুকু আছে যতটুকু সরকারের পক্ষে যায়।
তিনি আরও বলেন, অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন নানামুখী চাপ ও বিধিনিষেধের বেড়াজালে সাংবিধানিক এই অধিকার মলাটবদ্ধ নথিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর মুক্ত গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে যেমন দূর্বল করেছে, তেমনি জনগণের অবাধ ও নিরপেক্ষ তথ্য লাভের অধিকার খর্ব করছে।
বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন,গণমাধ্যম সরকার এবং জনগণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। যেকোনো রাষ্ট্রে গণমাধ্যম হবে গণমানুষের সারথিস্বরূপ। অসহায় মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, যন্ত্রণা, হতাশা, দুর্দশা, অধিকার, অসাম্য প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরে সমাধানের পথ ত্বরান্বিত করবে গণমাধ্যম। আবার দুর্নীতি, অপরাধ, অনাচার, অবিচার তথা সমাজের নেতিবাচক দিকগুলোর বিরুদ্ধেও হবে সোচ্চার।
বিএফইউজে মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন বলেন, গণমাধ্যম হচ্ছে নির্বাক মানুষের সবাক বন্ধু। গণমাধ্যম শব্দহীনের মুখে শব্দ ফোটায়, শক্তিহীনকে শক্তি দান করে। অন্যদিকে অপরাধী, অন্যায়কারী ও দুষ্টুজনের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া একটি সংশোধনকারী মাধ্যমও। তাই স্বাধীন বা নিরপেক্ষ গণমাধ্যম মানেই আপামর জনসাধারণের পক্ষে তাদের অব্যক্ত কথাগুলো বলার একটি বড় মাধ্যম। কিন্তু এদেশের গণমাধ্যমের সার্বিক অবস্থার দিকে তাকালে এর উল্টো চিত্রটাই চোখে পড়ে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও অপরিহার্য। কোনো রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের কথাই উঠে আসে গণমাধ্যমে। তাই এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যম মানুষের জন্য তথ্যের বৃহত্তর প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। সরকারের সমালোচনার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, এতে গণমাধ্যমের ভূমিকাই সর্বাধিক।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা জনগণের একটি মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ধারার ৩৯(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে এবং ৩৯(২) সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। আলোচনা, মতপ্রকাশ, ঐক্য হলো গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সিঁড়ি। যেখানে গণমাধ্যম যত বেশি শক্তিশালী সেখানে গণতন্ত্র ততো বেশি শক্তিশালী।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মুরসালিন নোমানী বলেন, গণমাধ্যমের সঠিক চর্চা যেমন গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারে, তেমনি প্রকৃত গণতন্ত্র পারে গণমাধ্যমকে স্বাধীন রাখতে। স্বাধীন গণমাধ্যম যে কোনো সরকারের সেরা বন্ধু। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচক হিসেবে ধরা হয়।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলামের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন- কবি আবদুল হাই শিকদার, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন, বাছির জামাল, রাশেদুল হক প্রমুখ।