জিন্নাতুন নূর
করোনাকালে বাংলাদেশের ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণীর মানসিক চাপ আগের চেয়ে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের মানসিক অস্থিরতায় ভুগে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণী শারীরিকভাবে নিজের ক্ষতি করছেন। মানসিক বিভিন্ন চাপের ফলে অনেকের মধ্যেই আত্মহত্যা করার প্রবণতা দেখা গেছে। এ সময় ৫০ দশমিক ১ শতাংশই আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা’ শীর্ষক নতুন এক জরিপে এমনটি উঠে এসেছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, করোনাকালে এত বেশিসংখ্যক তরুণের আত্মহত্যার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগের। মূলত তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, আত্মহত্যার কারণ চিহ্নিত করা এবং তার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার জন্যই এ জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে দেশে মোট ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। ৩২২টি আত্মহত্যার কেস স্টাডি করে দেখা যায়, যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের ৪৯ শতাংশেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। আর এদের ৫৭ শতাংশই নারী।
জানা যায়, ২০২১ সালে ১ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত পরিচালিত এই জরিপে মোট ২০২৬ জন মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জরিপে সবচেয়ে বেশি অংশ নেন ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী মোট ১৭২০ জন তরুণ-তরুণী। যা মোট জরিপের ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। আর জরিপে অংশগ্রহণকারীর ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশই অবিবাহিত। এদের মধ্যে অধিকাংশই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও অন্যান্য পেশার মানুষের মধ্যে ৭ দশমিক ১ শতাংশ চাকরিজীবী, শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ ব্যবসায়ী, বেকার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তাসহ অন্য পেশাজীবী ছিলেন ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্যে, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে কিন্তু তারা তা চেষ্টা করেননি। ৮ দশমিক ৩ শতাংশ আত্মহত্যার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম প্রস্তুত করলেও তা করতে পারেননি। ৩ দশমিক ৭ শতাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন।
তথ্য অনুযায়ী, তরুণদের মধ্যে অধিকাংশই মানসিক বিষণ্ণতায় ভোগেন। যেমন, অধিকাংশ সময় মন খারাপ থাকা, পছন্দের কাজ থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। অস্বাভাবিক কম বা বেশি ঘুম হওয়া, কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা, সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা। এ সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে তরুণরা। জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ১২৩৯ জনই (৬১.২%) বলেছেন, তারা বিষণ্ণতায় ভুগছেন। আর ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ জানান, তাদের মানসিক অস্থিরতার বিষয়ে কারও সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে পারেন না। মন খারাপ হলে বা বিষণ্ণ হলে তরুণ-তরুণীদের ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ বন্ধুদের সঙ্গে, ২২ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারের সঙ্গে এবং ১ দশমিক ৯ শতাংশ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা শেয়ার করেন। তবে জরিপে অংশগ্রহণকারী বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে কেউই তাদের শিক্ষকদেও সঙ্গে বিষণ্ণতার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন না। এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ৭৬ দশমিক ১ শতাংশের পরিমিত ঘুম হলেও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশের পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। এ ছাড়াও এই তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশই দৈনিক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন যা মানসিকভাবে তাদের বিপর্যস্ত করে তুলছে। জরিপে দেখা যায়, ২৮ শতাংশই দৈনিক ৬ ঘণ্টার বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেন। ২৬ শতাংশ দৈনিক ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা এবং ৩১ শতাংশ দৈনিক ২ থেকে ৪ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৯৪ শতাংশই বলছেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য তাদের দৈনন্দিন কাজগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে।
দুঃখজনক হলেও এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন। কিন্তু ৯১ দশমিক ৪ শতাংশই কখনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেননি।
তরুণ-তরুণীরা বলছেন, তারা যে ধরনের মানসিক চাপজনিত সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছেন সেগুলো হচ্ছে- পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ হারানো, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, একাকী অনুভব করা, অনাগ্রহ সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপ, আর্থিক সমস্যা, অতিরিক্ত চিন্তা করা, মোবাইল আসক্তি, আচরণগত সমস্যা, চাকরির অভাব, কাজের সুযোগ না পাওয়া, সেশনজট, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু ইত্যাদি।