টাকা বরাদ্দ ছিল গরিব ও অসহায় রোগীদের চিকিৎসায় সহায়তার জন্য। তবে এ টাকা থেকে সম্মানী দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তাদের। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ, কর্মসূচি পরিদর্শন, মুদ্রণ ও সফটওয়্যার হালনাগাদ (আপগ্রেডেশন) করাসহ আনুষঙ্গিক নানা খাতে খরচ করা হয়েছে অনুদানের এ টাকা।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের গরিব ও অসহায় রোগীদের এককালীন ৫০ হাজার টাকায় সহায়তা দেওয়ার কর্মসূচিতে এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সরকারের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের (সিএজি) নিরীক্ষায় বিষয়টি উঠে এসেছে। গত জুনে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সিএজি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় হাতে নেওয়া ওই কর্মসূচি হলো—‘ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইজ), জন্মগত হৃদ্রোগ ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত গরিব রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি’। সংশ্লিষ্ট এসব রোগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র, পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ (টেস্ট রিপোর্ট) করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক রোগীকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়।
সিএজির প্রতিবেদন বলছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০—এই চার অর্থবছরে অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ২৫৯ দরিদ্র রোগী। তাঁদের জন্য বরাদ্দ ১ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নীতিমালা লঙ্ঘন করে এবং উদ্দেশ্যের বাইরে গিয়ে কর্মকর্তাদের সম্মানী, প্রশিক্ষণ, কর্মসূচি পরিদর্শনসহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খাতে খরচ করা হয়েছে।
সিএজির প্রতিবেদন বলছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০—এই চার অর্থবছরে অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ২৫৯ দরিদ্র রোগী। তাঁদের জন্য বরাদ্দ ১ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নীতিমালা লঙ্ঘন করে এবং উদ্দেশ্যের বাইরে গিয়ে কর্মকর্তাদের সম্মানী, প্রশিক্ষণ, কর্মসূচি পরিদর্শনসহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খাতে খরচ করা হয়েছে।
বর্তমানে কর্মসূচিটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম-২-এর আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওই শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালের আগপর্যন্ত রোগীদের অনুদান দেওয়ার প্রকল্পটি ছিল পরীক্ষামূলক (পাইলট)। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সফটওয়্যার তৈরি ও এর ব্যবহার শেখাতে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ সম্মানী দেওয়ার নামে অনুদানের টাকা আত্মসাৎ করেন। অনুদানের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছিল না। এখন বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে মীমাংসার চেষ্টা চলছে।
সিএজির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারিভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৫ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এ টাকায় ওই চারটি অর্থবছরে যথাক্রমে ৬ হাজার, ১০ হাজার, ১৫ হাজার ও ৩০ হাজার ব্যক্তির অনুদান পাওয়ার কথা ছিল। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫০ জন, পরের অর্থবছরে ৬০ জন অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে বঞ্চিত হয়েছেন যথাক্রমে ৫৯ ও ৯০ রোগী। এভাবে চার অর্থবছরে মোট ২৫৯ রোগীকে অনুদান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
অনুদানের অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে সরকারের ‘ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইজ), জন্মগত হৃদ্রোগ এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত গরিব রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নীতিমালা-২০১৪’ রয়েছে। নীতিমালার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বরাদ্দ অর্থ শুধু চিকিৎসাসহায়তা বাবদ ব্যয় করা যাবে।
অনুদানের অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে সরকারের ‘ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইজ), জন্মগত হৃদ্রোগ ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত গরিব রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নীতিমালা-২০১৪’ রয়েছে। নীতিমালার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বরাদ্দ অর্থ শুধু চিকিৎসাসহায়তা বাবদ ব্যয় করা যাবে।
নীতিমালা ভঙ্গ করে ওই টাকা দরিদ্র রোগীদের না দেওয়ায় উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। একই সঙ্গে তা আর্থিক অনিয়ম।
যদিও অধিদপ্তর থেকে সিএজিকে তখন জানানো হয়েছিল, প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়, অর্থাৎ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ওই অর্থ মাঠপর্যায়ে ব্যয় করা হয়েছে। তবে নিরীক্ষার সময়ে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয়ের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা বাজেট বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তাই রোগীদের অনুদানের টাকা থেকে এসব খাতে ব্যয়ের কোনো সুযোগ নেই।
ওই সময় কর্মসূচির পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার। তিনি বর্তমানে অবসরে আছেন। আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় নিয়ে নিরীক্ষা আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অডিট হলে আপত্তি তো থাকবেই, থাকতেই পারে। আমরা এর যৌক্তিক কারণ দেখাই, উত্তর দিই। এটা নিয়মিত প্রসেস (প্রক্রিয়া)। সব জায়গায় এ রকম চলছে।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের আরও ৭টি ‘খাতিরের’ প্রকল্প আসছে, ব্যয় ১৬০ কোটি টাকা
সবকিছু স্মরণেও নেই, এমন দাবি করে আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, ‘যতটুকু জানা আছে, কিছু খরচপাতির জন্য ছোটখাটো একটা অনুমোদন ছিল। সেটা লিগ্যালি (বৈধভাবে) নিয়মতান্ত্রিকভাবে খরচ করা হয়েছে।’ এর বাইরে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নিরীক্ষা আপত্তির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছিল সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। তবে এখনো কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানান বর্তমানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।
চিকিৎসার অনুদান নিয়ে এমন গুরুতর অনিয়মের ব্যাপারে বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কয়েকজন বলছেন, নিরীক্ষা আপত্তি নিয়ে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেও আলাদা একটি কমিটি গঠন করে বিষয়গুলো যাচাই করা হচ্ছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা শাখার আওতাধীন এ কর্মসূচির বর্তমান পরিচালক মোকতার হোসেন। নিরীক্ষার সময়ে তিনি দায়িত্বে ছিলেন না বলে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, নিরীক্ষা আপত্তির বিষয়ে জবাব প্রতিবেদন আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।