তোফায়েল গাজালি; আজকের রাত বা রমজানের ২৭তম রাত সাধারণভাবে লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত হিসেবে পরিচিত। লাইলাতুল কদর অর্থ সম্মানের রাত। সূরা কদরে ঘোষণা করা হয়েছে- লাইলাতুল কদরের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি।
এক দিন প্রিয় নবী (সা.) এ ভেবে অস্থির হচ্ছিলেন যে, আগের নবীর উম্মতেরা দীর্ঘজীবন পেতেন। ফলে তারা অনেক বেশি ইবাদত বন্দেগির সুযোগ পেতেন। কিন্তু শেষ নবীর উম্মতের জীবন খুবই সীমিত। এত অল্প সময়ের ইবাদতে তারা মাবুদের কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করবেন কিভাবে। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা কদরের উপহার নিয়ে উপস্থিত হন হজরত জিবরাইল (আ.)।
শান্ত হন রাহমাতাল্লিল আলামিন (সা.) ও তার সাহাবিরা। আল্লাহতায়ালা এ রাতেই মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল করেছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তেমনি এ রাতটির মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে বেশি বলেও ঘোষণা করেছেন।
কিন্তু রাত কোনটি তা বলে দেননি। হাদিস শরিফেও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি কোনটি কদরের রাত। নিঃসন্দেহে এতে অনেক রহস্য ও তাৎপর্য রয়েছে। হয়তো আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূল (সা.) চাননি মুসলমানরা একটি রাতের ভরসায় বসে থেকে সারা বছর বা সারা মাস অবহেলায় কাটিয়ে দিক। এজন্য এটিকে রহস্যময় করে রাখা হয়েছে। তা ছাড়া পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমেই মূল্যবান কিছু অর্জন করতে হয়।
যে রাতের মূল্য হাজার মাসের চেয়ে বেশি, তা যদি সহজে পাওয়া যেত, তা হলে মানুষ হয়তো এটিকে বেশি গুরুত্ব দিত না। তাই তা অনির্দিষ্ট করে রেখে মানুষকে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে।
নবীজী (সা.) রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবেকদর তালাশ করতে বলেছেন। কেউ কেউ রমজানের যে কোনো অংশে এ রাত হতে পারে বলে মন্তব্য করেন।
কিন্তু বেশিরভাগ মনীষীর মতে রমজানের শেষ দশকেই তা লুকানো রয়েছে। আবার কারও কারও মতে, এ রাতের তারিখ পরিবর্তনশীল। কোনো বছর ২১, কোনো বছর ২৩, কোনো বছর ২৫, কোনো বছর ২৭ আবার কোনো বছর ২৯ তারিখের রাত লাইলাতুল কদর হয়। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে অনেক মনীষী রমজানের ২৭ তারিখের রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এ ব্যাপারে সাহাবিদের মধ্যে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ কারী হিসেবে আখ্যায়িত হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি জোর দিয়ে বলতেন, রমজানের ২৭তম রাতই কদরের রাত।
অন্যদিকে ফিকাহ ও ইজতেহাদের জ্ঞানে চার খলিফার পরই যার স্থান, সেই হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, এটি রমজানের বাইরেও হতে পারে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর মন্তব্য সম্পর্কে হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলতেন- আমার ভাই আবদুল্লাহ ভালো করেই জানেন, এটি রমজানের মধ্যে এবং তা ২৭তম রাত। কিন্তু লোকেরা এ রাতের ভরসায় বসে থাকবে এবং আলসেমিতে সারা বছর ও সারা রমজান মাস কাটিয়ে দেবে এ ভয়ে তিনি তা লোকদের জানাতে চান না।
হজরত উবাই ইবনে কাবকে (রা.) প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন সাতাইশ রমজানের রাতটিই কদরের রাত? জবাবে তিনি বলেন, এ রাতের যেসব আলামত মহানবী (সা.) আমাদের বলেছেন, আমরা সেগুলো সাতাইশ তারিখে পেয়েছি।
হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এবং হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) সহ এক দল মনীষীর ব্যাপারে বলা হয়, তারা রমজানের সাতাইশ তারিখের রাতকে লাইলাতুল কদর বলে মনে করতেন। এসব মনীষীর নাম যুক্ত হওয়ায় রমজানের ছাব্বিশ তরিখ দিবাগত রাতটি অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করার ধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
তবে মনে রাখতে হবে, কদরের রাতের যে মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য, তার মূল আকর্ষণ হল কোরআনুল কারিম। বিশ্বমানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য জীবন ব্যবস্থার চূড়ান্ত নির্দেশনা হিসেবে কোরআন শরিফ নাজিলের সঙ্গে রাতটি সম্পর্কিত হওয়ায় এত মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়েছে। অতএব, এ রাতের সুফল পুরোপুরিভাবে পেতে কোরআন শরিফের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করাই আসল কাজ।
বুঝে বুঝে কোরআন পাঠ, কোরআনের মর্ম অনুধাবন, নিয়মিত অধ্যয়ন এবং কোরআনের বিধান ও নির্দেশনা অনুসরণে জীবনযাপনই মুমিনের জীবনের সাফলতার চূড়ান্ত স্তর। লাইলাতুল কদরে নামাজ, তেলাওয়াত ও জিকির-তাসবিহের সঙ্গে যেমন অতীত জীবনের পাপ মোচনের জন্য প্রভুর কাছে আকুল আবেদন জানাতে হবে, তেমনি তার কাছে সাহায্য চাইতে হবে আল কোরআনের আলোকে আগামীর দিনগুলো আমরা যেন অতিবাহিত করতে পারি। হে আরশের মালিক মওলা! আপনি আমাদের সেই তাওফিক দিন। আমিন!
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : পবিত্র শবেকদর উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও মুসলিম জাহানের উত্তরোত্তর উন্নতি, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করেন।
কর্মসূচি : ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘১ জুন শনিবার রাতে সারা দেশে পবিত্র লাইলাতুল কদর পালিত হবে।’
তিনি বলেন, এ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আজ বাদ জোহর (বেলা দেড়টায়) বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ‘পবিত্র লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য’ শীর্ষক ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। ওয়াজ পেশ করবেন মিরপুর বায়তুল মামুর জামে মসজিদের খতিব ড. মুফতি আবদুল মুকিত আযহারী।
জাতীয় মসজিদসহ দেশের সব মসজিদেই তারাবির নামাজের পর থেকে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন থাকবে।
পবিত্র শবেকদর উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি রেডিওগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে। এছাড়া সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে।
লেখক : পরিচালক, ফিদায়ে মিল্লাত ইন্সটিটিউট
islamissk@gmail.com