রাজস্বকর্মীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলছে সারা দেশে অচল ব্যবসা-বাণিজ্য দিনে ২৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি : ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ পণ্য খালাস বন্ধ, বন্দরে তৈরি হচ্ছে পণ্যজট আদায় হচ্ছে না শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর

রাজস্বকর্মীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলছে সারা দেশে অচল ব্যবসা-বাণিজ্য দিনে ২৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি : ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ পণ্য খালাস বন্ধ, বন্দরে তৈরি হচ্ছে পণ্যজট আদায় হচ্ছে না শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

আর কর্মকর্তাদেরও দেশের স্বার্থে কাজে ফিরে যেতে আহবান জানিয়েছেন তাঁরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর বিভক্তির জেরে সংস্থার চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরেই আন্দোলন করছেন এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আগের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় তাঁরা গতকাল শনিবার প্রথমবারের মতো কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেন। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে তাঁরা সারা দেশে সংস্থার সব কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও আয়কর অফিসে কর্মবিরতি পালন করেন। এতে কোনো অফিসেই কাজকর্ম হয়নি। গ্রাহকরা সেবা নিতে পারেননি। সেবা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, এক দিনেই তাঁদের অন্তত দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। আন্দোলনকারীরা জানান, আজ রবিবারও ফের কমপ্লিট শাটডাউন চলবে। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দিয়েছে ঐক্য পরিষদ।

দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তাঁরা মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই শাটডাউন অর্থনীতির জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। এটা আমাদের অর্থনীতির শ্বাসনালিকে একেবারে চেপে ধরার মতো। অর্থনীতি শ্বাস নিতে পারবে না। কারণ বাণিজ্য না হলে কারখানায় উৎপাদন হবে না, খামারে চাষ হবে না; এমনকি দোকানে পণ্য আসবে না। এনবিআর কাজ না করলে জাহাজে মাল ওঠানো যাবে না। আর নামালে সেটা বন্দরে পড়ে থাকবে, খালাস করতে পারবেন না। তাহলে অর্থনীতি চলবে কিভাবে?’

তিনি বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব আদায় একেবারে শূন্যে দাঁড়াবে। শাটডাউন চলমান থাকলে রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারের কার্যক্রম চলবে কিভাবে? সার্বিকভাবে এই লাগাতার শাটডাউনের প্রভাব দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো। দেশের মানুষকে জিম্মি করে সরকারি কর্মকর্তাদের এই আন্দোলন শৃঙ্খলার পরিপন্থী। আপসহীন মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে। আলোচনা ছাড়া এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই।’

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আন্দোলন ঘিরে অচলাবস্থা এমন সময় এসেছে যখন দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। রপ্তানি একটি শক্তিশালী ধারায় যাচ্ছে। দুই বছর আমদানি সীমিত রাখার পর একটু বড় হচ্ছে। এমন অবস্থায় আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হওয়া অর্থনীতির ধারাবাহিকতা ও সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর রাজস্বের ওপর ভিত্তি করেই সরকারের কার্যক্রম চলে। আন্দোলন চলমান থাকলে গণতান্ত্রিক উত্তোরণ, সুশাসন পুনঃ প্রতিষ্ঠা ও জনগণের সেবা দেওয়ার সক্ষমতা কমবে। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়েছে, অনেক জটিল হয়েছে। এখন আর দেরি না করে প্রধান উপদেষ্টা বা অর্থ উপদেষ্টার একটা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে যেটা সবচেয়ে ভালো সমাধান আলোচনার মাধ্যমে তা করা উচিত।’

চলমান অচলাবস্থায় উদ্বেগ জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘চলমান অচলাবস্থার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সরকার তার সঠিক গুরুত্ব বুঝছে না। এই শাটডাউনের কারণে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমান স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা চাপে আছেন। এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে।’

 

শাটডাউনে চট্টগ্রাম কাস্টমসের চিত্র

কাস্টমসের কার্যক্রম স্থবির থাকায় দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর খোলা থাকলেও পণ্য খালাস হয়নি। রপ্তানিমুখী পণ্যের আনুষ্ঠানিকতাও বিঘ্নিত হয়েছে। পণ্যের শুল্কায়ন, বিল অব এন্ট্রি দাখিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বন্দরে আসা পণ্যের সরবরাহও ব্যাহত হচ্ছে। এই কর্মসূচি চলমান থাকলে বন্দরে কনটেইনার জট বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একই চিত্র সারা দেশের অন্য কাস্টম হাউসগুলোরও।

 

বেনাপোল-হিলিতে আটকা শত শত ট্রাক

গতকাল সকাল থেকেই বেনাপোলের পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি। বাণিজ্য বন্ধ থাকায় দুই দেশের বন্দর এলাকায় আটকা পড়েছে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক, যার বেশির ভাগই বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল। বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক মো. শামীম হোসেন জানান, ‘কাস্টমস কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে বেনাপোল বন্দর দিয়ে সকাল থেকে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তবে এ সময় বেনাপোল বন্দর থেকে ভারতীয় খালি ট্রাকগুলো সে দেশে ফেরত যেতে পারবে।’

দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের চিত্রও প্রায় একই। ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই ট্রাক বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। হিলি কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, ‘হিলি কাস্টমসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মস্থলে উপস্থিত থাকলেও কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করছেন।’ হিলি কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফেরদৌস বলেন, ‘সকাল থেকে হিলি স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে ৩৫ গাড়ি পণ্য আমদানি করেছেন। সেগুলোর শুল্কায়ন ও কায়িক পরীক্ষা বন্ধ।’

 

কী বলছে ঐক্য পরিষদ

শাস্তির হুমকি উপেক্ষা করেই সংস্থাটির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানকে অপসারণের দাবিতে রবিবারও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, শনিবারের মতো রবিবারও আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন যথারীতি চলবে। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই কর্মসূচির আওতাবহির্ভূত থাকবে।

 

সারা দিনের চিত্র

রাজস্ব ভবনের সামনেই পুলিশের জলকামান। ভেতরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র‌্যাব, কোস্ট গার্ড ও বিজিবির উপস্থিতি। অস্ত্র, লাঠি এবং আত্মরক্ষার ব্যাপক প্রস্তুতি। ভবনের ভেতরে ঢুকতে বাধা, ভেতরে থাকলে বাইরে যেতেও বাধা। যেন যুদ্ধের পুরোদস্তুর প্রস্তুতি। সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে এসেও নিজের অফিসে প্রবেশ করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন এনবিআর ভবনে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। দিনভর তাঁরা এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় চেয়ারম্যানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন পরিষদের নেতারা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের দৃষ্টি এড়াতে ভোর সাড়ে ৬টায় এনবিআর ভবনে নিজকক্ষে প্রবেশ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। পুরো সময়ে তিনি ভবনের ভেতরেই ছিলেন বলে দাবি তাঁদের। এ ছাড়া সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারেও এনবিআর চেয়ারম্যানের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে পোস্টার ছাপিয়ে দেয়ালে লাগানো হয়েছে।

 

চাপের মুখে শূন্য রাজস্ব আদায়

রাজস্ব আদায়ে বিরাট চাপের মধ্যে এনবিআর। ঘাটতি পোষাতে টানা দুই শনিবার অফিস খোলা রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে ঘটল ঠিক তার উল্টো। জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের ঘাড়ে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে হিসাবে প্রতি মাসেই এনবিআরকে আদায় করতে হতো ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই লক্ষ্য অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয় জেনে পরে লক্ষ্য কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছিল। তবে এই লক্ষ্য থেকেও অর্জন প্রায় লাখ কোটি টাকা দূরে।

সংশোধিত লক্ষ্য অনুযায়ী, এনবিআরকে প্রতি মাসে ৩৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। সে হিসাবে মে মাস পর্যন্ত ১১ মাসে আদায় হওয়ার কথা চার লাখ ২৪ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। অথচ প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এই সময় আদায় হয়েছে তিন লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত আদায়ের তুলনায় ৯৭ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কম। সে হিসাবে জুন মাসে লক্ষ্য পূরণ করতে হলে আদায় করতে হবে এক লাখ ৩৫ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয় শীর্ষ সংবাদ