ইয়াসিন রহমান; কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এই চক্র কেজিতে ২৫ টাকা বাড়িয়ে মাত্র সাত দিনে ভোক্তাদের পকেট থেকে প্রায় ২৩৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
আর মাসব্যাপী এ দামে পেঁয়াজ বিক্রি হলে আরও কয়েকশ’ কোটি টাকা যাবে তাদের পকেটে।
আর এর মধ্যে দাম যদি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে তাহলে তো পোয়াবারো। কোরবানির ঈদ এলেই অসাধু চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে মাসখানেক আগ থেকেই পেঁয়াজের দাম বাড়াতে শুরু করে তারা। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর একই কাজ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। কিন্তু এরপরও পণ্যটির দাম বাড়ায় উদ্বিগ্ন খোদ মন্ত্রণালয়ও। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক হয়। বাণিজ্য সচিবের নেতৃত্বে বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পেঁয়াজ, আদা ও রসুন ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বাণিজ্য সচিব মো. মফিজুল ইসলাম পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চান। তিনি বলেন, দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আছে। তাছাড়া পেঁয়াজ আমদানি হয় ভারত থেকে। সেখানেও যদি কেজিতে ১-২ টাকা বাড়ে, ওই হিসাবে দেশেও এক থেকে দুই টাকা দাম বাড়ার কথা। কিন্তু ২৫ টাকার পেঁয়াজ ৫০ টাকা হয় কীভাবে?
বাণিজ্য সচিব আরও বলেন, কারসাজি করে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ভোক্তা স্বার্থে দেশে আইনকানুন ও বিধিবিধান রয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেলে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। সচিবের প্রশ্নে সদুত্তর দিতে পারেননি ব্যবসায়ীরা।
তারা বলেছেন, অতিবৃষ্টি ও বন্যার জন্য পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া বৃষ্টির কারণে ভারত থেকে পেঁয়াজ সময়মতো আসতে পারছে না। বৃষ্টি কমে গেলে দাম কমবে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও ভারত থেকে পেঁয়াজ আসতে সময় লাগার দোহাই কতটা যুক্তিযুক্ত সেই প্রশ্নই ভোক্তাদের সামনে। জানা গেছে বৈঠকে বাজার মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
৫ জুলাই (শুক্রবার) রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৫-৩০ টাকা। কিন্তু দু’দিন পর এক লাফে দাম কেজিতে ২৫ টাকা বেড়ে ৫০-৫৫ টাকা হয়ে যায়। এখনও সেই দামেই বিক্রি হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। কোরবানির ঈদ এলে বাড়তি আরও ২ লাখ টনের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে কোরবানির ঈদ ঘিরে মাসে পেঁয়াজের চাহিদা তৈরি হয় ৪ লাখ টন। এ হিসাবে এক দিনে পেঁয়াজের চাহিদা ১৩ হাজার ৩৩৩ টন (১৩ কোটি ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৩ কেজি)। পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২৫ টাকা বাড়ানোর ফলে একদিনে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা করেছে ৩৩ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৩ টাকা। সে ক্ষেত্রে সাত দিনে তারা হাতিয়ে নিয়েছে ২৩৩ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৩ টাকা। আর মাসব্যপী এ দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরও কয়েকশ’ কোটি টাকা যাবে তাদের পকেটে।
রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি আড়ত ও কারওয়ান বাজারে পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৮ জুলাই দেশি পেঁয়াজ প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে ২২৫ টাকা। সে ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি দাম পড়ে ৪৫ টাকা। কিন্তু এর দু’দিন আগে শুক্রবার প্রতি পাল্লা বিক্রি হয় ১২৫ টাকা। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ২৫ টাকা।
খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কোরবানির ঈদ এলেই প্রতিবছর অস্থির হয়ে ওঠে পেঁয়াজের দাম। চলতি বছরও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২৫ টাকা। কারওয়ান বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা নজরুল বলেন, আড়তদাররা বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। যে কারণে আমাদের বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। আর বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতিবছর কোরবানির ঈদের সময় পেঁয়াজসহ অন্যান্য মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এবারও তা হয়েছে। কারা এগুলো করে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। কারওয়ান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা সেলিনা বেগম বলেন, এক লাফে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এতে করে আমাদের মতো নিুবিত্তরা বিপদে পড়েছেন। কোরবানির ঈদ এলেই ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়ায়। সরকার বলছে মজুদ অনেক আছে। তারপরও দাম বাড়ল কেন, বুঝতে পারছি না। জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, অধিদফতরের পক্ষ থেকে দিনে দুটি টিম বাজার তদারকি করছে। সপ্তাহ ধরে দেখা গেছে, পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে। কেন বেড়েছে তার কারণ বের করতে মোকাম থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি করা হচ্ছে। অসাধু উপায়ে দাম বাড়ানো হলে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।