আইন আদালত ডেস্ক
মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই পৃথক মামলায় সেনাবাহিনীর ১৩ কর্মকর্তাকে কড়া নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) ও জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি)–এ বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তিদের আটক, গুম এবং নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা এ মামলাগুলোতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ৩০ জন আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছেন। রোববার সকাল ১০টার দিকে প্রিজনভ্যানে করে সেনা কর্মকর্তাদের আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয় এবং পরে তাদের হাজতখানায় নেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এদিন দুই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। শুনানিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন এবং পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এ উপলক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণজুড়ে সকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি জোরদার করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত রয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া ১৩ সেনা কর্মকর্তা হলেন র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাসেম, মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।
গত ২০ নভেম্বর এ দুই মামলার শুনানির দিন নির্ধারিত থাকলেও প্রসিকিউশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি পিছিয়ে আজকের তারিখ ঠিক করা হয়। এর আগে, ২২ অক্টোবর সেনা হেফাজতে থাকা ১৩ কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে শুনানি শেষে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে পলাতক আসামিদের খুঁজে পেতে সাত দিনের মধ্যে দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলায় ৮ অক্টোবর প্রসিকিউশন মোট ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। অভিযোগে বলা হয়, টিএফআই সেলের গোপন স্থানে বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তিদের আটক রেখে নির্যাতন, জিজ্ঞাসাবাদ এবং গুমের ঘটনা সংঘটিত হয়। এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়। এ তালিকায় রয়েছেন তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন, সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ এবং র্যাব ও সেনাবাহিনীর আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। এ মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন ১০ সেনা কর্মকর্তা, বাকিরা পলাতক।
অন্য মামলাটি জেআইসি বা আয়নাঘরে বন্দিদের গুম ও নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা হয়। এ মামলায়ও শেখ হাসিনা ও মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম রয়েছে। এছাড়া আসামির মধ্যে রয়েছেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) সাইফুল আবেদিন, লে. জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক, মেজর জেনারেল তৌহিদুল ইসলাম, মেজর জেনারেল সরওয়ার হোসেন, মেজর জেনারেল কবির আহাম্মদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী ও লে. কর্নেল (অব.) মখসুরুল হক। এ মামলায় তিনজন কারাগারে থাকলেও অন্যান্য আসামি পলাতক রয়েছেন।
মামলাগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন হওয়ায় পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে সাক্ষ্যগ্রহণ, প্রমাণ উপস্থাপন এবং পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। আইনি বিশ্লেষকদের মতে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা এ ধরনের মামলার বিচার প্রক্রিয়া জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে।
এদিকে, মামলার শুনানি ঘিরে উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে মামলাসমূহের শুনানি চলমান থাকার কারণে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় এ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে।


