মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযান আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়িতেই ক্যাসিনো-বার!

 

 

 

নিজস্ব প্রতিবেদক;

 

রাজধানীর গুলশানে বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। গতকাল রবিবার বিকেলে চালানো এই অভিযানে বিপুল পরিমাণ মদ, গাঁজা, সিসা, বিয়ার ও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। ডিএনসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় সমালোচনায় আসা আজিজ মোহাম্মদ ভাই থাইল্যান্ডে থাকেন বলে তথ্য রয়েছে। গুলশানে তাঁর বাড়িতে গোপনে মাদক ও ক্যাসিনোর কারবার চলছিল। অভিযানের সময় বাসার কেয়ারটেকারসহ নবীন ও পারভেজ নামের দুজনকে আটক করা হয়েছে।

ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের সহকারী পরিচালক খুরশিদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয় গুলশান-২ নম্বর সার্কেলের ৫৭ নম্বর সড়কের ১১/এ নম্বর বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘বাসায় মদের মিনি বারে অবৈধ মাদক বিক্রি ও সেবন করা হয়, মজুদও করা হচ্ছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযানে এসে বাড়ির ছাদে একটি মিনি বারের সন্ধান পাই। সেখান থেকে বিদেশি ৩৮২ বোতল মদ, ২৪ ক্যান বিয়ার, দুই প্যাকেট সিসা (চার কেজি) ও ২০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়।’ তিনি আরো বলেন, এ ছাড়া এই ভবনে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনো পরিচালনার বিভিন্ন সরঞ্জাম যেমন—কয়েন, কার্ড, গুটি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া আজিজ মোহাম্মদের ভাই রাজা মোহাম্মদের বাসা থেকে আট বোতল মদ জব্দ করা হয়।

ডিএনসি সূত্রে জানা যায়, গতকাল বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অভিযান চালানো হয়। বাড়িটিতে আজিজ মোহাম্মদের ভাই রাজার পরিবার থাকে। আজিজের পরিবার সেখানে থাকে না। ভবনটির তিনটি তলায় অবৈধ সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। সেখানে মদ জড়ো করে পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছিল। বাড়ির ছাদে যে ক্যাসিনোটি পাওয়া যায় তাতে ডলারের মাধ্যমে খেলা হতো। সম্প্রতি রাজধানীতে যতগুলো ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, সব জায়গায় দেখা গেছে, খেলা হতো টাকা দিয়ে। কিন্তু এখানে খেলা হতো এক সেন্ট থেকে শুরু করে ১০০ ডলারের কয়েন দিয়ে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, ওই বাড়িতে উচ্চবিত্তশ্রেণির জুয়াড়িরা যেতেন। বাড়ির কক্ষগুলোতে মদ, বিয়ারের সঙ্গে সিসা ও গাঁজা রাখা ছিল। সেগুলো থরে থরে সাজানো ছিল। আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজস্ব লোক দিয়ে এসব পরিচালনা করতেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

আটক হওয়ার পর নবীন দাবি করেন, সাত-আট বছর ধরে তিনি বাড়িতে কাজ করলেও কখনো আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে দেখেননি। কমপ্লেক্সের মধ্যে দুটি বাড়ির একটির চারতলা ব্যবহার করেন আজিজের স্ত্রী নওরীন। দোতলায় থাকেন আজিজের ভাইয়ের ছেলে। ওই ভবনের অন্য তলায় কেউ থাকে না। আরেক ভবনের পাঁচ ও ছয়তলায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের দুই বোন সখিনা মীর আলী ও নুরজাহান হুদা বসবাস করেন। দোতলায় থাকেন বোনের সন্তানরা।

পারভেজ বলেন, তিনি এক মাস আগে এই ভবনের চারতলায় ওঠেন। যে কক্ষে মদ পাওয়া গেছে সেই কক্ষের দিকে যাওয়া তাঁদের ‘নিষেধ ছিল’ বলে দাবি করেন পারভেজ।

কে এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই?

প্রশাসনের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের রহস্যময় ব্যক্তিদের তালিকা করলে প্রথম দিকেই থাকবে আজিজের নাম। তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বেশির ভাগই চলচ্চিত্র জগতের নারী ও হত্যাকেন্দ্রিক। আজিজ মোহাম্মদ ভাই ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি হত্যা, মাদক পাচারসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। ৫০টির মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর তাঁদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ১৯৬২ সালে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের জন্ম আরমানিটোলায়। আজিজ মোহাম্মদ ভাই সার্ক চেম্বার অব কমার্সের আজীবন সদস্য। অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড ও বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস, এমবি ফিল্ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে তাঁর হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা আছে। মুম্বাইয়ের ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার গুঞ্জন আছে। আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এরশাদ আমলে। তাঁকে মুক্ত করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন প্রিন্স করিম আগা খান।

১৯৯৬ সালে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু ঘটনাটি আত্মহত্যা বলেই প্রচার পায়। বেশ কয়েক বছর ধরেই আজিজ মোহাম্মদ ভাই সপরিবারে থাইল্যান্ডে থাকছেন। তাঁর স্ত্রী নওরিন মোহাম্মদ দেশে এসে ব্যবসা দেখেন। তাঁর তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। থাইল্যান্ডে গেলে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের অনেকেই আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের আতিথেয়তা পান। ১৯৯৮ সালে ঢাকা ক্লাবে খুন করা হয় আরেক চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে। ওই হত্যাকাণ্ডেও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তাঁর পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। ২০০৭ সালে তাঁর ভাতিজা আমিন হুদা ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেপ্তার হলে একই অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধেও ওঠে। ২০১৩ সালে আমিন হুদার ৭৯ বছরের জেল হয়েছে। এটিই ছিল ইয়াবা-সংক্রান্ত প্রথম আলোচিত মামলা।

১৯৯৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বিএসইসি। ওই মামলায় গত বছরের ২৯ আগস্ট আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ঢাকার একটি ট্রাইব্যুনাল। এখন তিনি পলাতক।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ