বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে ক্রমাগত বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। এক কথায় বলা যায়, ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এমন পরিস্থিতিতে এই খাতে বড় ধসের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ব্যাংক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি প্রতিরোধ তো দূরের কথা, বরং আরো বৃদ্ধিতে সময়ে সময়ে আইন সংস্কার করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনই অভিযোগ খাত সংশ্লিষ্টদের।
ব্যাংক খাতের অন্যতম অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ও পরিচালকদের অনুকূলে ঋণ বিতরণ। শুধু এক পিকে হালদারই বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এমনই নামসর্বস্ব একাধিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে ৩১৮ কোটি টাকা ঋণ।
গত বছরের নভেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের নামে পাঁচটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া ও কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে জাল রেকর্ডপত্র প্রস্তুত করে ঋণ পেতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়।
সম্প্রতি দেশ ছেড়ে পালানো সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধেও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেডসহ কয়েকটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
তবে সে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর রহস্যজনক কারণে তার নামে মামলা করে দুদক। এ ছাড়া ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে একইভাবে ৩০টি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে আলোচিত পিকে হালদারের বিরুদ্ধে। আবার জাল দলিল জামানত রেখে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আর এ কাজে সহযোগিতা করেছে স্বয়ং প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়, ব্যাংক পরিচালকরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। নিজ নামের পাশাপাশি অনেক সময় পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজন বা নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণের অনুমোদন দিচ্ছেন।
কারণ পর্ষদেও যে তারাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। ভাই-বোন, স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা এমনকি পুত্রবধূ বা জামাতাও থাকেন পরিচালক হিসেবে। পরিচালকদের বাইরে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অনিয়মে জড়িত থাকার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা ঋণ আদায়ের চেয়ে ঋণ প্রদানকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
এ ক্ষেত্রে অনেক সময় পরিচালনা পর্ষদের চাপে পড়ে, আবার কখনো টেবিলের নিচের কার্যক্রমই তাদের বেশি আকর্ষিত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের চেয়ারম্যানের অনিয়ম-দুর্নীতিতে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ রয়েছে এবং মামলা চলমান। এমনকি অনেক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এর সাথে জড়িত থাকে। আলোচিত পিকে হালদারকে ঋণ দেয়ায় সহায়তা করার অভিযোগে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের চার কর্মকর্তাকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
কিন্তু এসব সমস্যার মূল হিসেবে, আইনি বিধান অনুসারে শাস্তি প্রদান না করার পাশাপাশি অতি দ্রুত ধনী হওয়ার প্রবণতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা ও কার্যকরী ভূমিকা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি যুগোপযোগী আইনের অভাব ও বাজারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যাধিক্যকেও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, সারা বিশ্বে যেখানে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বিবেচনায় বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশে অনুমোদন দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত উপেক্ষা করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে সরকার। ফলে অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হলেও সেবার মান রয়ে গেছে আগের মতোই।
অথচ প্রতিবেশী বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারতেও সরকারি-বেসরকারি মিলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৩৪টি। ফলে আমাদের দেশের এসব ব্যাংক অর্থনীতিতে সম্পদ সৃষ্টি না করে উল্টো বোঝা বাড়াচ্ছে।
সম্প্রতি দেশের ব্যাংকিং খাতে চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল-সিএজি। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। অবশ্য আগের বছর এর পরিমাণটা আরো বেশি ছিল। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কম-বেশি যাই হোক, এই অনিয়ম থেকে কি সহসাই মুক্তি মিলবে, এমন প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে দেশের সব ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ এক হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা, মোট অগ্রিমের পরিমাণ ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। এই সময়ে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করেছে তিন লাখ ৫৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা।
এই সময় অগ্রিম ক্লাসিফাইড (ইকোনমিক পারপাস) হয়েছে মোট এক লাখ ১৭ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। এছাড়া অ্যাডভান্স ইকোনমিক পারপাস অগ্রিম ক্লাসিফাইড হয়েছে ২৯ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এদিকে বর্তমানে ঋণখেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৬৮ কোটি টাকায়।
ব্যাংকি খাতের এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে দৈনিক আমার সংবাদের সাথে কথা বলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আপাতত ব্যাংক খাতের সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। পরিত্রাণে যাদের কাজ করার কথা, তারাই এটা করছে না। ইতোমধ্যে আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সবই হয়েছে তাদের স্বার্থে।
যেমন— পরিবারের সব সদস্যকে পরিচালক বানানো, এ ক্ষেত্রে আগে যে সীমা ছিল তা ভেঙে আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা তো বাংলাদেশ ব্যাংক করেছে। প্রভাবশালীদের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে, এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন যেটা হচ্ছে তা হলো— বাংলাদেশ ব্যাংকে যতগুলো সিদ্ধান্ত হয়, তার চেয়ে বেশি সিদ্ধান্ত হয় হোটেলগুলোতে রাতের বেলা। যারা ঋণখেলাপি তাদের অংশগ্রহণেই হয় সিদ্ধান্তগুলো। এ থেকে সহসাই পরিত্রাণ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর-প্রশাসনিক কর্মকর্তারা, অর্থ মন্ত্রণালয় তারা এ সব কিছুই দেখে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঋণখেলাপিদের তফসিল, পুনঃতফসিল, অবলোপনসহ খেলাপিদের বারবার সুবিধা দেয়া হয়। দেখা যায় খেলাপি থেকে ক্লিন ইমেজে পরিণত হয় তারা। হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বেসিক ব্যাংকের বিষয়ে দেখুন। এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ কোনো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না।
দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কোম্পানি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এত প্রাইভেট ব্যাংক দরকার নেই। ভারতের মতো এত বড় একটা দেশের চেয়েও বাংলাদেশে প্রাইভেট ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। ব্যাংকগুলোর ভূমিকা দেখেই বোঝা যায়, অনিয়মগুলো করার জন্যই তাদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এগুলো হচ্ছে এ কারণে যে, যারা দ্রুত বড়লোক হতে চায় তাদের একটা পথ করে দেয়া। এ জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত দ্রুত ধনী হতে ব্যাংকগুলোকে একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কারণেই এ অবস্থা। আমাদের শক্ত ধারণা হচ্ছে, ব্যাংকের অনুমোদন যারা দিচ্ছে তারাও এসব ব্যাংকের সাথে জড়িত। তাদের মাধ্যমেই যদি অনিয়ম হয়, সেটা দূর হবে কিভাবে?
এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের অনুমোদন বন্ধ করে দিলে মুক্তি সম্ভব কি-না, জানতে চাইলে বলেন, সরকার যদি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংক খাতে লুটপাট বন্ধের, তাহলে সব কিছুই পরিবর্তন হয়ে যাবে। আইন পরিবর্তন হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসন পরিবর্তন হবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ধরন পরিবর্তন হবে, অনেক প্রাইভেট ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে। এগুলো সবই হবে, যদি সরকার সিদ্ধান্ত নেয়।
অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ব্যাংক খাতের অনিয়ম আসলে কোনো নির্দিষ্ট একপক্ষের দায় না। এ থেকে পরিত্রাণে ব্যাংক খাতের যে আইনগুলো আছে সেগুলো হালনাগাদ করা দরকার এবং এগুলো যেন দ্রুত প্রয়োগ করা যায় সে দিকটা দেখা।
দ্বিতীয়ত হলো, যখন একটি নতুন ঋণ অনুমোদন দেয়া হয় তখন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের উপরে গেলে ঋণগ্রহীতার তথ্যগুলো যেন কঠোরভাবে নিরীক্ষা করা হয়। এর পাশাপাশি সে কেন ঋণ নিচ্ছে, কত বছরের সময়ে, আগের ঋণের পোর্টফোলিও সব বিবেচনায় এনে নতুন ঋণ অনুমোদন দেয়া দরকার।
তৃতীয়ত, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের দুই জনের বেশি কোনোক্রমেই থাকা যুক্তিসঙ্গত নয় এবং এটি ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না। এর সাথে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে শাস্তির বিধানটা পরিপালন করা জরুরি। কিন্তু আমরা এটা দেখতে পাচ্ছি না। এ জন্য প্রয়োজন আইনগুলোকে সংশোধন করে দ্রুত সময়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা।
তবে যতক্ষণ পর্যন্ত শাস্তির বিধান না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তত সামাজিক কিছু প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা, যেমন— পাসপোর্ট জব্দ করা, ব্যাংকিং লেনদেন ফ্রিজ করে রাখা ইত্যাদি। মূলত দুটি বিষয়ের প্রতি আমি জোর দেবো— শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং নতুন ঋণ অনুমোদনে কড়াকড়ি। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলামের কাছে জানতে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে মোবাইলে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো সাড়া দেননি।