একের পর এক ছাড় দিয়েও কমছে না খেলাপি ঋণ। তাই ঋণ অবলোপনের পথে হাঁটছে ব্যাংকগুলো। গত চার বছরে ৯৩৭৭ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে সব ব্যাংক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবলোপন হলো খেলাপি ঋণের একটা পরিণতি।
ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ। ব্যালেন্সশিট স্বচ্ছ দেখাতে কাগজে-কলমে খেলাপি আড়াল করছে ব্যাংকগুলো। এটা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। বরং ব্যাংকগুলো ভেতরে ভেতরে আরও রুগ্ণ হয়ে উঠছে। গত বৃহস্পতিবার এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের অবলোপনের মাধ্যমে ২৪৪১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যা তার এর আগের বছরের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। এর আগে ২০২০ সালে অবলোপন করা হয়েছিল ৯৭১ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯ সালে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ বাদ দিতে অবলোপন করা হয়েছিল ২৫৯৭ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত চার বছরে ব্যাংকগুলো রাইট অফ বা অবলোপন করে ৯৩৭৭ কোটি টাকার মন্দ মানের ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ আদায় না করে যদি রাইট অফের কৌশল বেছে নেওয়া হয় তবে এক সময় ব্যাংকের মূলধনও থাকবে না। তাই এটিকে ভালোভাবে নেওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, যদি এমন হতো ব্যাংকগুলো রাইট অফ করে জোর দিয়ে ঋণ আদায় করছে তাহলে এ উদ্যোগ ইতিবাচক হতো। কিন্তু তারা শুধু ব্যালেন্স শিট ঠিক রাখতেই রাইট অফ করছে।
এতে বাইরে থেকে লোকজন মনে করছে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো। বাস্তব চিত্র কিন্তু উল্টো। সেজন্য এটা ঠিক হচ্ছে না।
খেলাপি ঋণ কমাতে অবশ্যই ঋণ আদায়ে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ে টার্গেট দিতে হবে। টার্গেট পূরণ না করতে পারলে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমিয়ে দিতে হবে। তাদের বলতে হবে যতটুকু ঋণ আদায় করতে পারবে ততটুকু ঋণ দিতে পারবে। তা না হলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়।
ব্যাংক ব্যবস্থায় মন্দ বা ক্ষতিকর মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রেখে স্থিতিপত্র (ব্যালান্সশিট) থেকে বাদ দেওয়াকে ঋণ অবলোপন বলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। ঋণখেলাপি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ওই সময় ব্যাংকের স্থিতিপত্র ঠিক রাখতে অবলোপনের নীতিমালা জারি হয়। এর পর ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অবলোপন সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে ৩ বছর হলেই মন্দমানের (কুঋণ) খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে পারবে ব্যাংকগুলো। আগে ৫ বছর না হলে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত না। এছাড়া আগে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপন করার সুযোগ ছিল; এখন তা বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। মূলত কাগজে-কলমে খেলাপি কম দেখাতে এ সুবিধা নিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করায় ঋণখেলাপিরা উৎসাহিত হয়েছেন। এখন তাদের ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে ব্যালান্সশিট ভালো দেখাতে ব্যাংকগুলো এ সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে আড়াল হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র। অবলোপন থেকে ঋণ আদায় খুবই কম। তারপরও অবলোপনে ব্যাংকগুলোকে নীতি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার জন্যও অতিরিক্ত সময় পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। কয়েক বছর ধরেই এ প্রভিশন সংরক্ষণের অতিরিক্ত সময় নিয়ে আসছে সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক।
অবলোপন ব্যাপক বাড়লেও এ থেকে ঋণ আদায় কমেছে। ২০২১ সালের ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) আগের অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় হয় ৪৭২ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২০ সালে তা ছিল ৭৩৬ কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালে ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন হলেও ওই বছর আদায় হয় মাত্র ৮৩১ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণ অবলোপন হলো খেলাপিরই একটা পরিণতি। যতক্ষণ খেলাপি বন্ধ না হবে ততক্ষণ ঋণ অবলোপনও চলতে থাকবে। ব্যাংক কখনো ব্যালেন্সশিট অপরিষ্কার রাখবে না, এটাই স্বাভাবিক। আগে গোড়ায় হাত দিতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কীভাবে বন্ধ করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। তা না হলে এসব বন্ধ হবে না।