বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবার সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছে বিএনপি। বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচন নয়—এই এক দফা সামনে রেখে অন্যান্য দলের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে দিয়ে একটা ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা এগোচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংলাপের মাধ্যমে সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে ঐক্য স্থাপনের পর যুগপৎ আন্দোলনের দিকে যাবে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের একটি পর্যায়ে গিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গড়া হবে। এর মূল লক্ষ্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি
মানতে বাধ্য হয়।
ঈদ, বন্যা ও পদ্মা সেতুর বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ নানা কারণে গত প্রায় এক মাস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সংলাপ বন্ধ ছিল। তবে সংলাপের এই বিরতিতে ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে বিএনপি।
‘আমরা আশাবাদী যে সরকারবিরোধী সব দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তি—সবার মধ্যে একটা ঐকমত্য হবে। এই সরকারের অধীন নির্বাচন নয়, তাদের পদত্যাগ করতে হবে—এই দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
১২ ও ১৩ জুলাই অনুষ্ঠিত এ দুটি বৈঠকের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, দুটি বৈঠকেই মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আগামী সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে। ওই নেতা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টের পর বিএনপির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর বৈঠক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে দলটির ঐক্যপ্রক্রিয়াকে বেগবান করতে সহায়ক হবে।
তবে এর আগেও জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছিল। সাম্প্রতিক এই বৈঠক দুটিকেও তেমন বা গতানুগতিক বৈঠক কি না, সে আলোচনাও বিএনপির ভেতরে–বাইরে আছে।
জানা গেছে, বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে আরও কিছুদিন সময় নেবে বিএনপি। তার আগে অন্য দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে বোঝাপড়ার পর্ব শেষ করতে চায় দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশাবাদী যে সরকারবিরোধী সব দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তি—সবার মধ্যে একটা ঐকমত্য হবে। এই সরকারের অধীন নির্বাচন নয়, তাদের পদত্যাগ করতে হবে—এই দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলন এক মোহনায় বা এক মঞ্চে মিলে যাবে। এটা আমাদের প্রত্যাশা।’
অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান বিএনপির সংলাপ বন্যা ও ঈদ এবং পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের কারণে সংলাপ বন্ধ ছিল। এর মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর করোনায় আক্রান্ত হন।
‘এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যায়নি। এখন দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা হবে।’
ইকবাল হাসান মাহমুদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
এ ছাড়া ঐক্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দলের আরেক নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও দেশের বাইরে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে চলতি জুলাই মাসের শেষ নাগাদ আবার সংলাপ শুরু হতে পারে। আ স ম আবদুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) অথবা রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হকের গণ অধিকার পরিষদকে দিয়ে সংলাপ শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।
এর আগে প্রথম ধাপে ১০টি দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ করেছে বিএনপি। গত ২৪ মে মাহমুদুর রহমান মান্নার দল নাগরিক ঐক্যকে দিয়ে এর শুরু। এরপর বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-ভাসানী) সঙ্গে সংলাপ হয়। সব দলই নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নামতে একমত হয়েছে।
এই সংলাপকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে শরিক করার প্রক্রিয়া বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যায়নি। এখন দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করা হবে।’
‘বিএনপির চিন্তা একটাই—একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর এই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। এ লক্ষ্যে বিএনপির আন্দোলন চলমান আছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়, আন্দোলন বেগবান করতে হবে।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান সংলাপকে দুই ধাপে সাজিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। প্রথম ধাপের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়।’ এই এক দফা দাবিতে যে দলগুলো নীতিগতভাবে একমত হবে, তাদের সবাইকে এক জায়গায় আনা।
এই পর্ব শেষে দ্বিতীয় ধাপে আলোচনা হবে বর্তমান সরকারের দলীয়করণের কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়া রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কেমন হবে, সে বিষয়ে। এই দুই পর্বের সংলাপ শেষে আলোচনার মাধ্যমে মাঠের কর্মসূচির ধরন ও কৌশল ঠিক করা হবে বলে দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিএনপির চিন্তা একটাই—একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর এই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। এ লক্ষ্যে বিএনপির আন্দোলন চলমান আছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়, আন্দোলন বেগবান করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারের সুবিধাভোগী নয়, এমন দলগুলো একমত হয়েছে। আশা করি, আমরা শিগগিরই যথাযথ আন্দোলন কর্মসূচি উপস্থাপন করতে পারব।’