ঢাকার বায়ুদূষণের প্রভাব মানুষের ওপর এমনভাবে পড়ছে যে প্রতিদিন মানুষ ঘর থেকে সুস্থভাবে বের হয় আর ঘরে ফেরে অসুস্থ হয়ে। জনে জনে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা। ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। অসহায় বোধ করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। ঢাকায় ব্যক্তিগত ও সরকারি নানা ধরনের নির্মাণকাজ থেকেই সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ঘটছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
ভবন নির্মাণ আর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে যেমন নীতিমালা সঠিকভাবে মানা হয় না, আবার পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও দূষণ রোধে নেই জোরালো কোনো পদক্ষেপ। সিটি করপোরেশন পানি ছিটানোর কাজ করলেও তা নিয়ে আছে আদালত ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অসন্তুষ্টি।
এদিকে মাত্র দুই দিন আগেই সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার এবং গ্রিনপিসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া শাখার করা এক গবেষণায় তথ্য প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাতাসে ২.৫ পিএম (পার্টিকুলেট ম্যাটার) আকারের ভারী কণার দূষণে ২০১৮ সালে বিশ্বে ৪৫ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা গেছে ৯৬ হাজার মানুষ।
শ্বাসতন্ত্রের খ্যাতিমান চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, শুকনো মৌসুমে একযোগে বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বা অন্যান্য অপরিহার্য উন্নয়নকাজের উৎস থেকে পুরো ঢাকা মহানগরী প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পরিণত হয় ধূলিদূষণের ভাগাড়ে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবহন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ার দূষণ, যা মানুষের শরীরের বাইরে ও ভেতরে দুইভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়া পিএম ২.৫ ও পিএম ১০। এর মাধ্যমে মানুষের ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা শাখা-প্রশাখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ মেয়াদে শ্বাসতন্ত্রে যেমন এর প্রভাব পড়ছে, তেমনি হাঁপানির মাত্রাও বাড়ছে।
ডা. রাশেদুল হাসান বলেন, ঢাকায় শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা এখন এতই জটিল হয়ে উঠেছে যে কাশি দ্রুত নিরাময় করা যাচ্ছে না। ওষুধও কাজ করছে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। যা নিয়ে আমরা এখন রীতিমতো অসহায় বোধ করছি। কারণ বায়ু ও ধূলিতে এমন সব রাসায়নিকের মিশ্রণ ঘটছে যে তা ওষুধে সামাল দেওয়ার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এই জনস্বাস্থ্যবিদ পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘উন্নয়ন হয় মানুষের জন্যই। আর মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচানোর জন্যই ঢাকার বায়ু ও ধূলিদূষণ কমাতে হবে। নয়তো সামনে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে। এ জন্য জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা করা ও বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে।’
তবে নীতিমালার তোয়াক্কা না করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের চলছে সড়ক খনন। মহাসড়কে চলমান বড় প্রকল্পগুলোতে পানি ছিটিয়ে বায়ুদূষণ রোধে ন্যূনতম ব্যবস্থা নেওয়া হলেও অলিগলি খোঁড়াখুঁড়ির সময় কোনো ধরনের নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে খনন করে তা ঠিক না করায় ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী। আবার উন্মুক্ত স্থানে বালু, মাটি, পাথরসহ অন্যান্য নির্মাণ পণ্য খোলা রাস্তায় ফেলে রাখায় সৃষ্টি হচ্ছে বায়ুদূষণ। রাজধানীতে সেবাদানকারী বিভিন্ন সংস্থাকে রাস্তা কাটার অনুমতি দিলেও নীতিমালা অনুযায়ী সে কাজ হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত মনিটরিং হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে। তবে দুই সিটির কর্মকর্তাদের দাবি, তাঁরা নিয়মিত তা মনিটর করেন।
বায়ুদূষণে বরাবরই শীর্ষে থাকছে ঢাকা। গতকাল শনিবারও বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল এক নম্বরে। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার বায়ুদূষণের পেছনে ৫৮ শতাংশ দায়ী করে ইটভাটাকে। ঢাকার চারপাশে ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর কঠোর অবস্থানে থাকলেও কেন বায়ুদূষণ কমছে না তা নিয়ে একটি গবেষণা করেছে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রধান প্রধান এলাকায় ৪৬টি স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে তা উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। ৭ নভেম্বর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা এই গবেষণার ফল বলছে, সরকারের এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয় না থাকায় যে যার মতো করে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে। কোথাও ওয়াসা, কোথাও মেট্রো রেল, কোথাও বিআরটি, কোথাও ডেসকো তাদের কাজ করতে গিয়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছে। যার ফলে সেখান থেকে প্রচুর ধুলাবালি উড়ছে। এ কারণে ঢাকার বায়ুদূষণ কমছে না।
ক্যাপসের গবেষণায় ঢাকার পল্টন মোড়ে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র ধূলিকণা (পিএম ২.৫) পাওয়া গেছে ৪২৮ মাইক্রোগ্রাম, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে পাওয়া গেছে ৩৪০ মাইক্রোগ্রাম, রায়েরবাজারে ৩৪৯ ও উত্তরায় ৩০১ মাইক্রোগ্রাম।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ক্যাপসের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, কালশী রোড, মিরপুর ১০, ১১, ১২, সেনপাড়া রোড, পল্টন-প্রেস ক্লাব, নিকেতন রোড, নির্বাচন কমিশন কার্যালয় রোড, টঙ্গি ব্রিজ, এলিফ্যান্ট রোড, লালমাটিয়া আবাসিক এলাকায় তিন মাস ধরে রাস্তাগুলো উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ারভিজ্যুয়ালের দেওয়া তথ্য মতে, গতকাল শনিবার বায়ুদূষণে ১৭১ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকার অবস্থান ছিল এক নম্বরে। দ্বিতীয় অবস্থানে ভারতের মুম্বাই, তিন নম্বর অবস্থানে নেপালের কাঠমাণ্ডু ও চতুর্থ অবস্থানে ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচেন।
বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থা উন্নতি হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন নিজে কিছু বলতে চাননি। তিনি মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক উদ্দিন আহাম্মদও কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।’
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, দুই সিটিতে দেড় শতাধিক রাস্তার খননকাজ চলছে। কাজের ধরন ও গুরুত্বভেদে বিভিন্ন সময়ের অনুমোদন দিয়ে থাকে সিটি করপোরেশনের ওয়ানস্টপ সেল। তবে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই একটানা ১৫ দিনের বেশি সময় দেওয়ার বিধান নেই। এর বেশি সময় প্রয়োজন হলে কয়েকটিভাবে ভাগ করে সময় দেওয়া হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন থেকে সময় নেওয়ার পরও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উন্নয়নকাজ শেষ করতে পারে না বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া জনভোগান্তি এড়াতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাবিশসহ (আবর্জনা) অন্য মালামাল সরানোর বিধান রয়েছে। এ ছাড়া রাবিশ সরানোর বিস্তারিত পরিকল্পনা সিটি করপোরেশনে জমা দেওয়ার কথা; কিন্তু সেই পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয় না। উপরন্তু এসব রাবিশ দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে রেখে তা মানুষের চলাচল অনুপোযোগী করে রাখা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রাবিশ না সরাতে পারলে নিজস্ব জনবল দিয়ে সিটি করপোরেশন তা সরিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা সেবাদানকারী সংস্থার কাছ থেকে জরিমানা আদায় করার কথা; কিন্তু নানা চাপে জরিমানাও আদায় করতে পারে না সিটি করপোরেশন। সেবা সংস্থাগুলো ছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি বানানোর সময়ও স্বল্প পরিসরে রাস্তা খনন হয় বেশ। মূলত বাড়িতে বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন নেওয়ার জন্য এই খননকাজ করা হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও অনেক সময় নীতি মানা হয় না।
এ ছাড়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নির্মাণকাজ পরিচালনার সময় নির্মাণসামগ্রী রাস্তার পাশে রাখা হয়। উন্মুক্ত স্থানে এসব মাল রাখার কারণে সৃষ্টি হয় বায়ুদূষণ। এ ছাড়া রাতের বেলায় কাজ করার কথা বলা হলেও দিনে চলে বেশির ভাগ সড়কের কাজ। বায়ুদূষণ রোধে স্বল্প পরিসরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও ধূলিদূষণ ঠেকাতে তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাস্তা খনন করে রাবিশ সরানো হয় না। এ ছাড়া খনন করে মাসের পর মাস খোলা অবস্থায় রাখা হয় সড়ক। উন্নয়নকাজ এবং নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র উন্মুক্ত ফেলে রাখার কারণে সৃষ্টি হয় বায়ুদূষণ।’
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, সেবাদানকারী সংস্থা অনেক সময় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। তবে ঠিকাদার ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার চাপে অনেক সময় তাদের জরিমানা বা অন্য কোনো শাস্তির আওতায় আনা কঠিন হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান প্রকৌশলী শরীফ উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী খননকাজ নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করি। তবে অনেক সময় নানা চাপে তা করা যায় না। তার পরও সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা।’
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ্ ইমদাদুল হল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সড়ক খননের অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতি দেওয়ার সময় শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়। সেই শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উন্নয়নকাজ শেষ করতে না পারলে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।’