হঠাৎ দেশে কেন বেড়ে গেল এত ইউটিউবার

হঠাৎ দেশে কেন বেড়ে গেল এত ইউটিউবার

কয়েক মিনিটের ভিডিও ভিউ বাড়লে হাজার থেকে লাখ টাকা ইনকাম। ঘরে বসেই যদি এমন সহজ আয়ের উৎস হাতের কাছে থাকে তাহলে আর চিন্তা কিসের। দেশে ফেসবুক, টিকটক, লাইকির মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি জনপ্রিয় এখন মার্কিন ভিডিও-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব। অনেকের কাছে এটি অর্থ আয়ের জন্য একটি অন্যতম মাধ্যম হিসাবে গড়ে উঠছে।

একসময় ইউটিউবে তথ্যনির্ভর, রুচিশীল মার্জিত কনটেন্ট থাকলেও অর্থ আয়ের ভিড়ে এখন অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটররা হাঁটছেন ভিন্ন পথে। কেউ কেউ ভাইরাল টপিক নিয়ে ভুয়া তথ্য দিয়ে কনটেন্ট তৈরি করে ভিউ বাড়াতে অর্থ আয়ের চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ উষ্ণতা বাড়াতে ঝুঁকছেন পর্নোগ্রাফি কনটেন্টের দিকে। কেউ কেউ আশ্রয় নিচ্ছেন প্রতারণার। কখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান ব্যক্তি বা তারকাদের নিয়ে আপত্তিকর ও বানোয়াট ভিডিও ছাড়া হচ্ছে ইউটিউবে। পরে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। প্রশ্ন উঠছে হঠাৎ কেন বেড় গেল এতো ইউটিউবার?

মহামারী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় এখনো বিধিনিষেধ মেনেই চলতে হচ্ছে সবাইকে। এতে কিছু ক্ষেত্রে এর অযৌক্তিকতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সমাজের এক অংশের মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। এর জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোও ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখা গেছে, ইউটিউবে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় তিনগুণ। তবে ভিউ ও অর্থ কামানোর প্রতিযোগিতায় এই মাধ্যমের সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারই বেশি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় তরুণদের বড় একটা অংশ ইউটিউব মুখী হয়েছেন। যাদের কেউ কেউ অবসর সময় পার করতে, কেউ কেউ ইউটিউব তারকা হয়ে উঠতে এবং অনেকেই আবার অর্থ উপার্জন করতে এই মাধ্যমে ব্যাপক হারে তৎপর হয়েছেন। প্রতিনিয়ত ভিউ ও অর্থ কামানোর নেশায় তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মাধ্যমটির সঠিক ব্যবহার করছেন না, মেতে উঠছেন অসুস্থ প্রতিযোগিতায়।

তাদের মতে, ইউটিউবে অপচর্চাটা বেশি হচ্ছে। যার ক্ষতিকর প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর পড়ছে। বিনোদন ও প্রচার মাধ্যম হিসেবে ইউটিউবে প্রতিনিয়ত গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। যে কোনো বিষয়বস্তুকে অতিরঞ্জিত করার প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত সেসব ইউটিউবাররা ভিউ আর অর্থ উপার্জনের দৌড়ে ব্যস্ত। এতে দরকারি ও মানসম্মত কন্টেন্টগুলো হারিয়ে যাচ্ছে গুজব আর মিথ্যাচারের ভিড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সেন্সরশিপ ও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে ইউটিউবের এই অপচর্চা বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেননা, একদিকে মহামারী থেকে তৈরি সংকট ও অন্যদিকে আধুনিক বিশ্বায়ন মানুষকে ঘরমুখী করে দিচ্ছে। বিনোদন, সংস্কৃতি চর্চা, শিক্ষা ও কর্ম-সবই এখন অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছে। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ সব শ্রেণির মানুষই এতে অভ্যস্ত।

ইউটিউবে দেখা যায়, সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে যে কোনো কনটেন্টকে আকর্ষণীয় করে তুলতে চটকদার নানা উপকরণ যুক্ত করা হচ্ছে। সেখানে সেন্সরশিপ না থাকায় সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে মূলধারার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যে কেউই যে কারো চরিত্রহরণ করে ভিউ আর অর্থ কামাতে ব্যস্ত। বিনোদন কনটেন্টগুলোর ক্ষেত্রেও অপসংস্কৃতির ছড়াছড়ি। আবার এসব কনটেন্ট ইউটিউব ছাপিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ভিডিও শেয়ারিং সাইটে ছড়িয়ে পড়ছে। ফেসবুকেও এগুলোর ছড়াছড়ি।

প্রতারণার মাধ্যম হিসেবেও ইউটিউবকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান ব্যক্তি বা তারকাদের নিয়ে আপত্তিকর ও বানোয়াট ভিডিও বানিয়ে ছাড়া হচ্ছে ইউটিউবে। পরে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। এ নিয়ে জিডি করেছেন অনেকে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি বিভাগের অধ্যাপক কে এম আককাছ আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি কোনো নীতিমালা নেই। আছে অবাধ স্বাধীনতা, তাই অনেকে অর্থ আয়ের পথ হিসেবে ইউটিউবের দিকে ঝুঁকছে। ইচ্চে মতো চ্যানেল খুলে মনগড়া ভিডিও আপলোড করছে। অনেক শিশু কিশোর লাইভ গেইম চ্যানেলগুলোতে আসক্ত হচ্ছে। এখনকার কনটেন্টগুলোতে ক্রিয়েটিভির কিছু চোখে পড়ে না। মূলত ধর্ম, যৌনতা, রূপচর্চা, স্পোর্টস, বিনোদন রিলেটেড কনটেন্টগুলোর ভিউ বেশি লক্ষ্য করা যায়।

তিনি বলেন, সাইবার ক্রাইম আগের থেকে অনেক বেড়েছে। ক্ষোভের কারণে মানহানি বা চাঁদাবাজি করতেও মনগড়া কনটেন্ট তৈরি করতে দেখা যাচ্ছে। আবার সরকার বিরোধী অনেক ভিত্তিহীন কনটেন্টও তৈরি হচ্ছে। বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নে দেশের বাইরে থেকে কনটেন্ট তৈরি করে তা টাকা দিকে ছড়িয়ে দেওয়া (প্রমোশন/বুস্ট) হচ্ছে।

অধ্যাপক কে এম আককাছ আলী আরও বলেন, দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে অনেকেই বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে এইদিকে আসছেন। কেউ কেউ অবসর সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরাও ভিডিও কনটেন্ট তৈরিতে ঝুঁকছেন। তবে ইউটিউব কনটেন্টের জন্য সরকারের উচিত নীতিমালা তৈরি করে দেওয়া। ইউটিউব চ্যানেল ক্রিয়েটরদের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে বে-আইনি কিছু করলেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

বাংলাদেশের তরুণদের অনেকেই এখন পেশাদারভাবে ইউটিউব এবং ফেসবুকের জন্য কনটেন্ট তৈরি করছেন। এসব ভিডিও দেখা হচ্ছে অসংখ্যবার। বাংলাদেশের একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর সৌভিক আহমেদ বলেন, এখন তো অনেক ইউটিউবার বেড়ে গেছে। আমরা যারা ছিলাম তারা কিন্তু এখনো কাজ করছি, তবে কম। এখন যারা নতুন তারাও নতুন নতুন আইডিয়া শেয়ার করছে, কন্টেন্ট ক্রিয়েট করছে। কেউ রান্না নিয়ে, কেউ বা শর্টফিল্ম, আবার কেউ গেম শো, মজার অনুষ্ঠান বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান বানাচ্ছে।

তিনি বলেন, এখনকার সময়ের সবাই অনেক বেশি ইয়াং ও ডেডিকেটেড। এখনকার ট্রেন্ড, কন্সেপ্ট এখনকার মতো; আগের মতো হবে না। তবে এখনকার সময়ে অনেক রকম ইউটিউবার হয়েছে যারা কন্সেপ্টের বিষয়ে ক্লিয়ার না। কি করবে আর কি বানাবে সেটা সম্পর্কে অজ্ঞ। ফলে বাজে কিছু কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে। তবে আমরা বরাবরই আশাবাদী।

অপরাধ আন্তর্জাতিক তথ্য প্রুযুক্তি