টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে গ্রুপ ‘বি’তে নিজেদের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে পাপুয়া নিউ গিনিকে ৮৪ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই জয়ে সুপার টুয়েলভ নিশ্চিত করেছে টাইগাররা।
‘বি’ গ্রুপে ৩ খেলায় ৪ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে এখন বাংলাদেশ। তাদের রান রেট ১ দশমিক ৭৩৩। তবে কিছুক্ষণ পর এই গ্রুপের শেষ ম্যাচে ওমানের মুখোমুখি হবে স্কটল্যান্ড। ঐ ম্যাচে ওমানকে হারালে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবে স্কটিশরাই। তখন গ্রুপ রানার্স আপ হবে বাংলাদেশ।
এছাড়া এ ম্যাচ আজ নিজেদের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রানে জয়ের রেকর্ডও গড়লো বাংলাদেশ। টাইগারদের এর আগের বড় জয়টি ছিল ৭১ রানের। ২০১২ সালে বেলফাস্টে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জিতেছিলো বাংলাদেশ।
রেকর্ড গড়া ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৮১ রানের বড় সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ। ২৮ বলে ৫০ রান করেন মাহমুদুল্লাহ। জবাবে ৯৭ রানে অলআউট হয় পাপুয়া নিউ গিনি।
ওমানের আল আমেরাত ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ম্যাচে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্বান্ত নেয় বাংলাদেশ। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন আগের ম্যাচে ৬৪ রান করা ওপেনার মোহাম্মদ নাইম। আজকের ম্যাচে রানের খাতা খেলার আগেই বিদায় নেন তিনি।
শুরুর ধাক্কাটা ভালোভাবে কাটিয়ে ওঠেন আরেক ওপেনার লিটন দাস ও সাকিব আল হাসান। প্রথম ১৬ বলে কোন বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারি পায়নি বাংলাদেশ। ১৭তম বলে প্রথম স্লগ সুইপে ফাইন লেগে উপর দিয়ে ছক্কা মারেন লিটন। পরের ওভারে লং-অন দিয়ে ছক্কা আসে সাকিবের ব্যাট থেকে। ঐ ওভারে ১টি বাউন্ডারিও আদায় করে নেন লিটন।
এরপর পাওয়া প্লের বাকী ওভারগুলোতে আর কোন বাউন্ডারি ও ওভার বাউন্ডারি না আসলেও ৬ ওভার শেষে ৪৫ রান পায় বাংলাদেশ। সপ্তম ওভারে হাফ-সেঞ্চুরিতে পৌঁছায় বাংলাদেশের স্কোর। তবে অষ্টম ওভারের প্রথম বলে লিটন-সাকিবের জমে যাওয়া জুটি ভেঙ্গে যায় । ২৩ বলে ১টি করে চার-ছক্কায় ২৯ রান করে লিটন আউট হলে। সাকিব-লিটন জুটির কাছ থেকে ৪১ বলে ৫০ রান পায় টাইগাররা।
লিটনের বিদায়ে উইকেটে আসেন মুশফিকুর রহিম। উইকেটে সেট হতে সতর্কতার সাথে এগুলেও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি তিনি। ৫ রান করে আউট হন মুশি। এতে ৭২ রানে তৃতীয় উইকেটের পতন ঘটে। মুশফিকের সাথে ১৯ বলে ২২ রান যোগ করেন সাকিব।
এরপর অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহকে নিয়েও বড় জুটির পথে ছিলেন সাকিব। দলের স্কোর শতরান স্পর্শ করার পরই থেমে যান তিনি। ১৪তম ওভারের দ্বিতীয় বলে পাপুয়া নিউ গিনির অধিনায়ক আসাদ ভালাকে ছক্কাও মারেন সাকিব। তার ছক্কাতেই দলের রান তিন অংকে পা রাখে।
কিন্তু চতুর্থ বলে আবারো ছক্কা মারতে গিয়ে লং-অনে ভালার বলে সাকিবের দুর্দান্ত ক্যাচ দেন চার্লস আমিনি। দারুন ব্যাট করতে থাকা সাকিব চার রানের জন্য হাফ-সেঞ্চুরি মিস করেন। ৩টি ওভার বাউন্ডারিতে ৩৭ বলে নিজের ৪৬ রানের ইনিংসটি সাজান দলের সেরা অলরাউন্ডার।
সাকিবের বিদায়ের পর বাংলাদেশের রানে চাকা দ্রুত ঘুড়িয়েছেন মাহমুদুল্লাহ। সাকিব যখন আউট তখন অধিনায়কের রান ছিলো ১১ বলে ১৬। পরে মারমুখী মেজাজে ২৭ বলে হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন মাহমুদুল্লাহ। এবারের আসরে এখন পর্যন্ত এটিই দ্রুততম হাফ-সেঞ্চুরি। গতকাল ২৯ বলে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২৯ বলে হাফ-সেঞ্চুরি করেছিলেন নামিবিয়ার দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড় ডেভিড ওয়াইজ।
১৭তম ওভারে ২টি ছক্কা ও ১টি চার মারেন মাহমুদুল্লাহ। একই ওভারে ১০৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ষষ্ঠ হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ পান অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত ২৮ বলে ৩টি করে চার-ছক্কায় ৫০ রান করে আউট হন মাহমুদুল্লাহ। তখন ১৬ বল বাকী ছিল এবং দলীয় রান ছিল ১৪৪।
অধিনায়ক ফিরলেও রান তোলায় ভাটা পড়েনি বাংলাদেশের। আফিফ হোসেনের মারমুখী ব্যাটিং বাংলাদেশকে বড় স্কোরের পথে নিয়ে যেতে থাকে। তিনটি চারে দলের স্কোর ১৬০ অতিক্রম করান তিনি। কিন্তু ১৯তম ওভারের শেষ বলে থামতে হয় ১৪ বলে ২১ রান করা আফিফকে।
শেষ ওভারে প্রথম চার বল থেকে তিন রান নিতে পারেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন ও মাহেদি হাসান। তবে পঞ্চম বলে ছক্কা মারেন সাইফুদ্দিন। শেষ বলেও ছক্কা পান সাইফুদ্দিন, আর এই ডেলিভারিটি নো ছিলো। তাই অতিরিক্ত শেষ বলে চার দিয়ে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ করেন সাইফুদ্দিন। ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৮১ রান করে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের মঞ্চে টাইগারদের এটি সর্বোচ্চ দলীয় রান।
৬ বলে ১টি চার ও ২টি ছক্কায় অপরাজিত ১৯ রান করেন সাইফুদ্দিন। ২ রানে অপরাজিত থাকেন মাহেদি। পাপুয়া নিউ গিনির কাবুয়া মোরেয়া-ড্যামিয়েন রাভু ও ভালা প্রত্যেকে ২টি করে উইকেট নেন।
জয়ের জন্য ১৮২ রানের বড় টার্গেটে খেলতে নেমে প্রথম দুই ওভারে কোন বিপদ হয়নি পাপুয়া নিউ গিনির। তবে তৃতীয় ওভার থেকে পাপুয়া নিউ গিনিকে চেপে ধরে বাংলাদেশের বোলাররা। তৃতীয় ওভারে সায়াকাকে শিকার করে বাংলাদেশকে প্রথম সাফল্য এনে দেন সাইফুদ্দিন। পরের ওভারে পাপুয়া নিউ গিনির অধিনায়ক ভালাকে শিকার করেন আরেক পেসার তাসকিন আহমেদ।
দুই পেসারের সাথে উইকেট শিকারের আনন্দে মাতেন সাকিব। পঞ্চম ওভারে দু’টি উইকেট তুলে নেন তিনি। আমিনিকে ১ ও আতাইকে খালি হাতে ফেরান সাকিব। এ অবস্থায় ১৪ রানেই ৪ উইকেট হারায় পাপুয়া নিউ গিনি। এ অবস্থায় চাপমুক্ত হওয়াই প্রধান লক্ষ্য ছিলো তাদের।
কিন্তু নবম থেকে একাদশ ওভারের মধ্যে পাপুয়া নিউ গিনির আরও ৩ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে বড় জয়ের স্বপ্ন দেখান সাকিব-মাহেদি। এ সময় আরও ২ উইকেট পকেটে ভরেন ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হওয়া সাকিব। সব মিলিয়ে ম্যাচে ৪ উইকেট শিকার সাকিবের। যার মাধ্যমে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারে যৌথভাবে পাকিস্তানের শহিদ আফ্রিদির সমান এখন সাকিব। সাকিব-আফ্রিদি উভয়েরই শিকার ৩৯টি করে।
২৯ রানে সপ্তম উইকেট পতনে দ্রুত গুটিয়ে যাবার শংকায় পড়ে পাপুয়া নিউ গিনি। সেই শংকা থেকে দলকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন ডোরিগো ও সোপার। অষ্টম উইকেটে ২৫ রান যোগ করেন তারা। পাপুয়া নিউ গিনির রানও হাফ-সেঞ্চুরিতে পৌঁছায়। ১১ রান করা সোপারকে আউট করে দলীয় ৫৪ রানে জুটি ভাঙ্গেন সাইফুদ্দিন।
এমন অবস্থায় পাপুয়া নিউ গিনির শেষ ২ উইকেট পতন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় মাত্র । কিন্তু বাংলাদেশের জয়কে দীর্ঘায়িত করেন আট নম্বরে নামা কিপলিন ডোরিগা। তার ৩৪ বলে অপরাজিত ৪৬ রানে শতরানের কাছে যেতে পারে পাপুয়া নিউ গিনি। শেষ পর্যন্ত ৩ বল বাকী থাকতে ৯৭ রানে অলআউট হয় দলটি। বাংলাদেশের সাকিব ৯ রানে ৪টি, সাইফুদ্দিন-তাসকিন ২টি করে উইকেট নেন। মাহেদি নেন ১ উইকেট।
স্কোর কার্ড : (টস- বাংলাদেশ)
বাংলাদেশ ইনিংস :
নাইম ক বাউ ব মোরিয়া ০
লিটন ক বাউ ব ভালা ২৯
সাকিব ক আমিনি ব ভালা ৪৬
মুশফিকুর ক হিরি ব আতাই ৫
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ক সোপার ব রাভু ৫০
আফিফ ক রাভু ব মোরিয়া ২১
নুরুল ক বাউ ব রাভু ০
সাইফুদ্দিন অপরাজিত ১৯
মাহেদি অপরাজিত ২
অতিরিক্ত (বা-১, নো-২, ও-৬) ৯
মোট (৭ উইকেট, ২০ ওভার) ১৮১
উইকেট পতন : ১/০ (নাইম), ২/৫০ (লিটন), ৩/৭২ (মুশফিক), ৪/১০১ (সাকিব), ৫/১৪৪ (মাহমুদুল্লাহ), ৬/১৫৩ (নুরুল), ৭/১৬১ (আফিফ)।
পাপুয়া নিউ গিনি বোলিং :
মোরিয়া : ৪-০-২৬-২ (ও-১),
রাভু : ৪-০-৪০-২ (ও-৪),
সোপার : ৪-০-৫৩-০ (নো-২),
বাউ : ২-০-২০-০ (ও-১),
ভালা : ৩-০-২৬-২,
আমিনি : ২-০-৯-০,
আতাই : ১-০-৬-১।
পাপুয়া নিউগিনি ইনিংস :
সায়াকা এলবিডব্লু ব সাইফুদ্দিন ৫
ভালা ক নুরুল ব তাসকিন ৬
আমিনি ক নাইম ব সাকিব ১
বাউ ক নাইম ব সাকিব ৭
আতাই ক মাহেদি ব সাকিব ০
হিরি ক নুরুল ব সাকিব ৮
ভানুয়া ক মুশফিক ব মাহেদি ০
ডোরিগা অপরাজিত ৪৬
সোপার বোল্ড ব সাইফুদ্দিন ১১
মোরিয়া ক মুশফিক ব মুস্তাফিজ ০
রাভু অপরাজিত ক নুরুল ব তাসকিন ৫
অতিরিক্ত (লে বা-১, নো-১, ও-৩) ৫
মোট (অলআউট, ১৯.৩ ওভার) ৯৭
উইকেট পতন : ১/১১ (সায়াকা), ২/১৩ (ভালা), ৩/১৩ (আমিনি), ৪/১৪ (আতাই), ৫/২৪ (বাউ), ৬/২৪ (ভানুয়া), ৭/২৯ (হিরি), ৮/১১২ (সোপার), ৯/৮০ (মোরিয়া), ১০/৯৭ (রাভু)।
বাংলাদেশ বোলিং :
সাইফুদ্দিন : ৪-০-২১-২ (ও-২) (নো-১),
মুস্তাফিজ : ৪-০-৩৪-০ (ও-১),
তাসকিন : ৩.৩-১-১২-২,
সাকিব : ৪-০-৯-৪,
মাহেদি : ৪-০-২০-১।
ফল : বাংলাদেশ ৮৪ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)।