বিজয় দিবসে চলবে মেট্রোরেল

বিজয় দিবসে চলবে মেট্রোরেল

আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসেই রাজধানীর বুকে চলবে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। তাই উদ্বোধনের জন্য দিয়াবাড়ি স্টেশনে শুরু হয়েছে ব্যাপক তোড়জোড়। সিগন্যালিং ঠিকমতো হচ্ছে কি-না তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এখন দম ফেলার ফুরসত নেই প্রকৌশলীদের। বাণিজ্যিকভাবে প্রথম পর্বে চালু হচ্ছে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ। তাই নিয়মিত উত্তরা-আগারগাঁও পরীক্ষামূলক চলাচল করছে মেট্রোরেল। এ পথটুকু যেতে যাত্রীকে ভাড়া দিতে হবে ৭৫ টাকা।

দীর্ঘদিন ধরে মানসম্মত গণপরিবহনের অপেক্ষায় আছে রাজধানীবাসী। মেট্রোরেলের পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মানুষের সেই অপেক্ষার অবসান হবে। এ মহানগরীতে উত্তর-দক্ষিণমুখী সড়ক তুলনামূলক বেশি। পূর্ব-পশ্চিমমুখী সড়কের সংখ্যা অনেক কম। প্রথম চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকা মেট্রোরেলও উত্তর-দক্ষিণমুখী। চলতি বছরের আগস্টে এই অংশের সব কাজ শেষ করার ডেটলাইনে এগোচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রকল্পের প্রতি মাসের হিসাবানুযায়ী গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৭৮.৯৫ শতাংশ, যা চলতি মাসে ৭৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অগ্রগতি হচ্ছে প্রয়া ৯৩ শতাংশ।

প্রকল্প সূত্র জানায়, বিদ্যুৎচালিত এই মেট্রোরেল চলবে নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং সিস্টেমে। এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির অনুমোদনও পেয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্র্যানজিট কোম্পানি-ডিএমটিসিএল। আগস্টে সমন্বিত টেস্টিং শেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাণিজ্যিকভাবে ঢাকায় চলবে দেশের প্রথম মেট্রোরেল-এমআরটি লাইন সিক্সের প্রথম অংশ। আর আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসে আগারগাঁও থেকে মতিঝিলের বাকি অংশও চালু হবে।

অন্যদিকে মেট্রোরেল প্রকল্পের অধীনে প্রথম ট্রেন চালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন নাসরুল্লাহ ইবনে হাকিম। ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে তাকে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। আরো ৩০ জন চালকের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরপর আরো এক দফা চালক নিয়োগ করা হবে। ট্রেন থাকবে ২৪টি। তার দ্বিগুণ চালক নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত ১০ শতাংশ চালক নিয়োগ দেওয়া হবে। অতিরিক্ত এই চালক নিয়োগ দেওয়া হবে সংরক্ষিত (রিজার্ভ) হিসেবে। নাসরুল্লাহ ইবনে হাকিমের নিয়োগের পর থেকে তার শিক্ষানবিশ পর্ব শুরু হয়েছে। আগামী ২১ আগস্ট তার শিক্ষানবিশকাল শেষ হচ্ছে। তার বাড়ি খুলনার পাইকগাছায়। থাকছেন মেট্রোরেল প্রকল্পের ডিপো এলাকার অদূরে উত্তরার দিয়াবাড়িতে।

মোট ১৬টি মেট্রো স্টেশনের ৯টি আগারগাঁও থেকে দিয়াবাড়ি অংশে। স্টেশনের মূল ভবনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে বেশ আগেই। দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় উঠতে দুটি করে সিঁড়ি, এক্সেলেটর ও লিফট বসানোও প্রায় শেষ। এখন এক্সিট, এন্ট্রি ও টিকিটিংয়ের সব ধরনের যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ চলছে সমানে। তৃতীয়তলার প্ল্যাটফরমে ওয়েটিং জোন আলাদা করতে আঁকা হয়েছে ইয়েলো বার। নির্দিষ্ট দূরত্বে নির্ধারিত মাপের উচ্চ প্রযুক্তির দরজাও বসানো হচ্ছে। অন্যান্য সাধারণ স্টেশনের অবকাঠামো যেমন হয় মেট্রোরেল স্টেশনের কাঠামো ঠিক এরকম যে, এই অংশে যাত্রীরা অপেক্ষা করবে আর হলুদ লাইনটি তারা কখনই অতিক্রম করবে না। এখানে স্বয়ংক্রিয় দরজাটিও বন্ধ থাকবে। রেল এসে দাঁড়ানোর পরে এই দরজাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে। তখন যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার সুযোগ পাবেন। যখন যাত্রী ওঠা শেষ হবে দরজাটি আবার বন্ধ হয়ে যাবে।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক বলেন, আমাদের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আমরা বাণিজ্যিক চলাচল শুরু করতে চাই। এটা আমরা বিবেচনায় রেখে কিন্তু আমাদের কাজকর্ম করে যাচ্ছি। স্টেশনের যে রুট সিট আছে এর নিচের দিকের সব কাজ শেষ করা হয়েছে। কোন কোন জায়গায় ফাইন টিউনের কাজ সামান্য বাকি থাকতে পারে। সেগুলোও আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে।

তিনি জানান, কাজের গতি বাড়াতে বাড়তি জনবলও নিয়োগ করা হয়েছে প্রকল্পে। উত্তরা-আগারগাঁও এই অংশের ৯২ শতাংশের বেশি কাজ শেষ করে আনা হয়েছে। তাছাড়া ইন্ডিপেনডেন্ট একটা নেটওয়ার্ক সিস্টেম থাকবে, না হলে মেট্রোরেল সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায় না। সেটার এখন টেস্টিং কাজ আমরা করছি। সামনে কোনো জটিলতা না থাকায় শতভাগ কাজ শেষ করে আগস্টেই হবে সমন্বিত টেস্টিং। এমআরটি লাইন ৬ এ ভূমি অধিগ্রহণ, বর্ধিত অংশ নির্মাণসহ পাঁচটি খাতে সাড়ে এগারো হাজার কোটি টাকা খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানা, এ জন্য সরকার একটা কমিটি করেছে। আমরা সেই কমিটির কাছে মেট্রোরেল আইন এবং মেট্রোরেল বিধিমালাতে যে বিষয়গুলো বলা আছে তার ওপর ভিত্তি করে আমরা একটা প্রপোজাল সেই কমিটির কাছে পাঠিয়েছি।

২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তথা মেট্রেরেল প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য এমআরটি-৬ নামক ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথকে নির্ধারণ করা হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে দুদিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।

এমআরটি-৬ এর চূড়ান্ত রুট অ্যালাইনমেন্ট হলো- উত্তরা তৃতীয় ধাপ-পল্লবী-রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (চন্দ্রিমা উদ্যান-সংসদ ভবন) খামারবাড়ী হয়ে ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। এ রুটের ১৬টি স্টেশন হচ্ছে-উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর। ট্রেন চালানোর জন্য ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যা নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে।

২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে শুরু হয় ঢাকা মেট্রোর নির্মাণকাজের সূচনা। এমআরটি-৬ এর স্টেশন ও উড়ালপথ নির্মাণের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ২০১৭ সালের ২ আগস্ট। এদিন উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারের উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণ শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের স্টেশন ও উড়ালপথ নির্মাণ শুরু হয়। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই প্রকল্পের উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারিত থাকলেও করোনা মহামারির কারণে কাজের অগ্রগিত কমে যায়।

২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ এবং এমআরটি-৫ নামক লাইন দুটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকার দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে। এমআরটি-১ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। নতুন বাজার থেকে কুড়িল পর্যন্ত ৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রানজিশন লাইনসহ ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এই মেট্রোরেলের ১২টি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে এবং ৭টি থাকবে উড়াল সেতুর ওপর।

এমআরটি-৫ নির্মাণ প্রকল্পে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা দেবে জাপান আর বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের মোট ২০ কিলোমিটারের মধ্যে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে আর বাকি সাড়ে ৬ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে। এ রুটে মোট ১৪টি স্টেশন হবে, যার মধ্যে ৯টি হবে পাতাল আর ৫টি হবে উড়ালপথে।

জাতীয়