নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড় বিরোধীরা; নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে পরোক্ষ চাপ আছে বিদেশিদের; সঙ্গে আছে নিজ দলের শৃঙ্খলা রক্ষা- এ ধরনের নানা বাস্তবতায় আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে খুবই সতর্ক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি নির্বাচনে এলে করণীয় কী হবে, আর না এলে কী হবে, তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে তাদের। এর সঙ্গে আগামী নির্বাচনে জনপ্রিয় ও বিতর্কমুক্ত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়াকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন দলটি। তবে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব সংসদ সদস্য (এমপি) বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলকে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছেন, তাদের আর মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অন্তত একশটি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়ে গেছে বলে দলের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সূত্র বলছে, কিছু সংসদ সদস্যের ‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ড বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। আর কিছু এমপির দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে নেতিবাচক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। সবার আমলনামা রয়েছে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও দলের সাংগঠনিক প্রতিবেদনও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
বিতর্কিত এমপিদের পরিণতির বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি জনপ্রিয় ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এই দলে রাজনীতি করতে হলে নিয়মের মধ্যে চলতে হয়; কারও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ কাম্য নয়। শুধু দলে কেন, জনগণের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রেও এটি পরিমাপক হিসেবে দাঁড়ায়। তাই সব সময়েই দলের ভেতরে এসব বিষয় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে দলীয় মনোনয়ন বোর্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, কোথাও একটা ঘটনা ঘটলেই অনেক কথা বলা যায় না। এ নিয়ে অনেক যাছাই-বাছাইয়ের বিষয় আছে।’
কয়েক দিন আগে একজন কলেজ অধ্যক্ষকে পেটানোর অভিযোগে রাজশাহী-১ (গাদাগাড়ী-তানোর) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। তার এই কর্মকা- নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে জোর সমালোচনা চলছে। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই গত শনিবার জাতীয় সংসদে কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ও দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আর এসব ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনার ইস্যু পাচ্ছে অন্যান্য রাজনৈতিক দল। এতে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে বলে দলটির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা মনে করেন।
রাজশাহী-১ আসনের এমপি এবং কুমিল্লা-৪ আসনের এমপির ‘বিতর্কিত’ কর্মকা-ের জেরে অতীতের বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোও আলোচনায় আসছে। নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, বরগুনা-২ আসনের হাচানুর রহমান রিমন, ঢাকা-৫ আসনের কাজী মনিরুল ইসলাম মনু, জামালপুর-৪ আসনের ডা. মুরাদ হাসান, গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ প্রায় অর্ধশত এমপির নেতিবাচক কর্মকা- নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দলের ভেতরে-বাইরে। এদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে জমা হচ্ছে অভিযোগের স্তূপ। বেশির ভাগ এমপির বিরুদ্ধে দলে ‘মাইম্যান’ তৈরি, নিজ এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার, অসদাচরণ, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, দলীয় পদ-পদবি নিয়ে বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক এমপি দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ মানা তো দূরের কথা, কাউকে পাত্তাই দেন না। অভিযুক্তদের মধ্যে ডা. মুরাদ হাসান ও গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের দলীয় শাস্তি হওয়ায় তারা বর্তমানে অনেকে নীরব রয়েছেন। কিন্তু অন্য বিতর্কিত এমপি ও জনপ্রতিনিধিরা দলীয় নির্দেশ অমান্য করে নেতিবাচক কর্মকা- অব্যাহত রেখেছেন। ফলে স্থানীয় এমপি বনাম আওয়ামী লীগ নেতার দ্বন্দ্ব-দূরত্ব দীর্ঘ হচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে এসব এমপি বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে দলটির একাধিক নেতা মনে করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য বলেন, সারাদেশের জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট ও দলীয় রিপোর্ট আমলে নিয়ে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, একসময় কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী, নেত্রকোনা সদর আসনের সংসদ সদস্য আরিফ খান জয়সহ প্রায় এক ডজন নেতা লাগামহীন হয়ে পড়েছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিন্তু তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সুতরাং যারা এখন বেপোরোয়া, তারা এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ একটা সুশৃঙ্খল দল। এই দলের নেতাকর্মীদের নিকট থেকে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা আমরা আশা করি না। রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের পর সাংগঠনিক রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুমিল্লা-৪ আসনের সংসদ সদস্যের বিষয়ে দলের চট্টগ্রাম বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, হঠাৎ করে একটা ঘটনা ঘটে গেলে এর ওপর মন্তব্য করা কঠিন। বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। আগামী ২১ জুলাই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। এর আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। দলীয় নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো নেতার কাছে আমরা দায়িত্বহীন আচরণ প্রত্যাশা করি না। সবাইকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত থেকে এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে রাজনীতি করতে হবে।