জাওয়াদ তাহের
আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য বিশেষ কিছু সময় ও মৌসুম দিয়েছেন যে সময়ে বান্দা অধিক ইবাদত ও ভালো কাজ করে সহজেই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে। মুমিনের জন্য এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত। অতীতে ঘটে যাওয়া ছোট-বড় গুনাহসমূহ মার্জনা করানোর সুবর্ণ সুযোগ বটে। এই বরকতময় সময়ের মধ্য থেকে একটি হচ্ছে, ‘মহররম ও আশুরা’।
নিম্নে আমরা এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করব।
বরকতময় মাস
আরবি মাস হিসেবে প্রথম মাস ‘মহররম’। এই মাসকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা যে চার মাসকে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন তার মধ্যে মহররম অন্যতম। আল্লাহ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে (অর্থাৎ লাওহে মাহফুজে) মাসের সংখ্যা ১২টি, সেই দিন থেকে, যেদিন আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)
আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, … বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম। তিনটি মাস পরস্পর রয়েছে। আর একটি মাস হলো রজব, যা জুমাদাল আখিরা ও শাবান মাসের মাঝে অবস্থিত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১৯৭)
অন্য হাদিসে এসেছে, (রমজানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মহররম বলে থাকো। (সুনানে কুবরা, হাদিস : ৪২১৬)
এ মাসের রোজা
রোজার জন্য রমজানের পর যে মাসকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মাস বলা হয়েছে তা হচ্ছে মহররম। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে, আল্লাহর মাস মহররমের রোজা…। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৪৫)
ইবনে রজব (রহ.) বলেন, আমাদের পূর্বসূরিরা তিন দশককে বেশি গুরুত্ব দিতেন—রমজানের শেষ ১০ দিন, জিলহজের প্রথম ১০ দিন এবং মহররমের প্রথম ১০ দিন। (লাতাইফুল মাআরিফ)
আশুরার তাৎপর্য
এ মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। এ দিনের বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলত রয়েছে। ইতিহাসের বহু স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে এই দিনে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে রোজা রাখো কেন?) তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মুসা (আ.) রোজা রাখেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মুসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে রোজা রাখেন এবং রোজা রাখার নির্দেশ দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০০৪)
আশুরার ফজিলত
এই বিশেষ দিনের কিছু ফজিলত রয়েছে। বিভিন্ন হাদিসের মাঝে তা বর্ণিত হয়েছে। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহর নিকট আমি আশা পোষণ করি যে, তিনি আশুরার রোজার মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছরের (গুনাহ) ক্ষমা করে দেবেন। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৭৫২)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এ দিন ব্যতীত রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো মাসকে এ মাসের (রমজান) তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে রোজা রেখেছেন আমার জানা নেই। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৫২)
আশুরার রোজার হুকুম
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজা ওয়াজিব না মুস্তাহাব ছিল এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের দ্বিমত রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজা ওয়াজিব ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এ দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, (জাহেলি সমাজে) লোকেরা রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোজা রাখত। এ দিন কাবায় গিলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে এ দিন রোজা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫৯২)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এ দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব।
কোন দিন রোজা রাখব
মহানবী (সা.) ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ মহররম মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ৯ তারিখে রাখতে পারলে ভালো। কারণ হাদিসে ৯ তারিখের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যখন আশুরার রোজা রাখছিলেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! এ দিনকে তো ইহুদি-নাসারারা সম্মান করে? তখন নবীজি এ কথা শুনে বললেন, ইনশাআল্লাহ, আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও রোজা রাখব। বর্ণনাকারী বললেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৫৬)
এ জন্য ইবনে আব্বাস (রা.) বলতেন, তোমরা ৯ তারিখ এবং ১০ তারিখ রোজা রাখো এবং ইয়াহুদিদের বিরোধিতা করো। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৫)
শিশুরাও এই রোজা রাখত
রুবায়্যি বিনতে মুআব্বিজ (রা.) বলেন, আমরা ওই দিন রোজা রাখতাম এবং আমাদের শিশুদের রোজা রাখাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ওই খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৬০)
তাওবার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া
তাওবা-ইস্তিগফার যেকোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ আমল। তবে কিছু কিছু সময় এমন রয়েছে, যখন তাওবার পরিবেশ বেশি অনুকূল হয়। বান্দার উচিত সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তগুলোর কদর করা। মহররমের এ মাসটি, বিশেষ করে ১০ তারিখ—এমনই এক মোক্ষম সময়। এদিনে তাওবা কবুল হওয়া, নিরাপত্তা এবং অদৃশ্য সাহায্য লাভ করার কথাও রয়েছে। এ জন্য এ সময়ে এমন সব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে আল্লাহর রহমত বান্দার দিকে আরো বেশি ধাবিত হয়।
এক সাহাবি নবীজির কাছে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! রমজানের পর আপনি কোন মাসে রোজা রাখতে বলেন? নবীজি বললেন, তুমি যদি রমজানের পর রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররমে রোজা রাখো। কেননা মহররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন এক দিন আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা (অতীতে) অনেকের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তাওবা কবুল করবেন। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৭৪১)