কলেজছাত্র দীপ্তজ্যোতি বসু ১ অক্টোবর জ্বরে আক্রান্ত হয়। প্রথম চার–পাঁচ দিনে জ্বর চলে না যাওয়ায় প্রথমে তার ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়নি। এর এক–দুই দিন পর তার করোনা পরীক্ষা করা হয়। করোনাও শনাক্ত হয়নি। দীপ্ত দুর্বল হতে থাকে। এর মধ্যে জ্বরের পাশাপাশি পেটে ব্যথা ও পাতলা পায়খানাও শুরু হয়। ১৭ অক্টোবর দীপ্তকে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বেসরকারি খিদমাহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন পরীক্ষায় জানা যায়, দীপ্ত প্যারাটাইফয়েডে আক্রান্ত।
দীপ্তর বাসা পূর্ব রামপুরার নতুনবাগ–লোহার গেট এলাকায়। গতকাল শনিবার দীপ্তর বাবা–মা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তাঁদের এলাকার অনেকেই জ্বর, ডায়রিয়া, জন্ডিস ও টাইফয়েডে আক্রান্ত হচ্ছে।
মৌসুমি জ্বর, করোনা ও ডেঙ্গুর কারণে টাইফয়েড অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে পড়ে আছে। তবে গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে বহু মানুষ নিয়মিত টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডে আক্রান্ত হচ্ছে।টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড পানিবাহিত রোগ। টাইফয়েডের জীবাণুর নাম সালমোনেলা টাইফি এবং প্যারাটাইফয়েডের জীবাণুর নাম সালমোনেলা প্যারাটাইফি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের লক্ষণ একই। দুটোই পানিবাহিত রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর হয়। জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রথম এক সপ্তাহ পায়খানা কষা হয়, পরের দিকে পায়খানা পাতলা হয়। পেটে ব্যথা হয়। খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।’
গতকাল পূর্ব রামপুরার নতুনবাগ লোহারগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে। কাজ শুরু হয়েছে মাস দুয়েক আগে। এলাকাবাসী বলেছেন, রাস্তার কাজ শুরুর পর থেকেই এলাকায় জ্বর, ডায়রিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েডের প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
আদনান ফার্মেসি নামের একটি ওষুধের দোকানি জানালেন, সাম্প্রতিককালে জ্বর, পাতলা পায়খানা ও জন্ডিসের ওষুধের বিক্রি বেড়েছে। মীম মডেল ফার্মা অ্যান্ড ডিপার্টমেন্ট স্টোরের কর্মীরা বলেন, গত দুই মাসে জ্বর ও পেটের নানা ধরনের অসুখের ওষুধের বিক্রি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। একটি হাসপাতাল বলেছে, তারা সম্প্রতি তিনজন টাইফয়েডের রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে।
সবুজবন নূর টাওয়ার এলাকায় বেশ পরিচিত। সেখানে ১৯৬টি ফ্ল্যাটে ১৯৬টি পরিবার থাকে। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করেন সারোয়ার জাহান। এই ব্যবসায়ী নিজে জ্বরে ভুগছেন। রোগ পরীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়ে বললেন, তাঁর তিন বছরের ছেলে টাইফয়েডে আক্রান্ত। রিপোর্টে সালমোনেলা টাইফির উল্লেখ আছে।
টাওয়ারের বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলেছেন, প্রায় প্রতিটি পরিবারে জ্বর, ডায়রিয়া, জন্ডিস বা টাইফয়েডের রোগী আছে। কেউ কেউ বলেছেন, ৭৫ শতাংশ ফ্ল্যাটে টাইফয়েডের রোগী।
সবুজবন নূর টাওয়ার ফ্ল্যাট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম ইয়াসিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিল। ছেলে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। স্ত্রী এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কত পরিবারে টাইফয়েড বা প্যারাটাইফয়েডের রোগী আছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে এ কে এম ইয়াসিন বলেন, ‘কমপক্ষে ৬০ শতাংশ পরিবারে এই সমস্যা আছে।’
এলাকার মানুষের ধারণা, রাস্তা সংস্কারের সময় পানির পাইপের সঙ্গে সুয়ারেজের পাইপ যুক্ত হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে। এলাকার বাসিন্দা তানভীর মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, পানির সমস্যার কথা তিনি ওয়াসাকে জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
গতকাল বিকেলে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) প্রায় সাড়ে পাঁচ শ শিশু ভর্তি ছিল। হাসপাতালের উপপরিচালক সহযোগী অধ্যাপক প্রবীর কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তি শিশুদের মধ্যে ৩০ জন টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের রোগী। তিনি আরও বলেন, এসব শিশুর বড় অংশ আদাবর এলাকার। ওই এলাকার পানিতে সমস্যা থাকতে পারে।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালে টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের গতিবিধি নিয়ে কাজ করছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের একদল বিজ্ঞানী ও গবেষক। তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধ গত জুলাই মাসে জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট–এ ছাপা হয়। এতে বলা হয়, ওই তিনটি দেশের মধ্যে টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের প্রকোপ বাংলাদেশে বেশি।
ওই গবেষকদের দলে আছেন ঢাকার চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে সারা বছরই কমবেশি টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকার ওই এলাকায় (পূর্ব রামপুরা নতুনবাগ–লোহার গেট) হঠাৎ এই রোগের প্রাদুর্ভাব কেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, পানি, তরল খাবার বা ফলমূল এই রোগের জীবাণু বহন করে। রাস্তার ফলমূল বা খাবার না খাওয়াই নিরাপদ। আর পানি নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে পানি ফুটিয়ে খাওয়া বা ব্যবহার করা উচিত।
টাইফয়েড বা প্যারটাইফয়েডে এখন মৃত্যুর ঘটনা তেমন না ঘটলেও একে খাটো করে দেখা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন সেঁজুতি সাহা। তিনি বলেন, ‘এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক দিন কাজে যেতে পারেন না। আক্রান্ত শিশুরা অনেক দিন স্কুলে যেতে পারে না।
অন্যদিকে এসব রোগী অনেক দিন হাসপাতালের শয্যা দখল করে থাকে। এটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ। সুতরাং রোগ যেন দেখা না দেয়, সে জন্য সবার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা জরুরি।’