হাজার হাজার ক্রেতা-বিক্রেতার শত শত কোটি টাকার পাওনা বুঝিয়ে দিতে না পারা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালিকে কোম্পানি আইন অনুযায়ী অবসায়নের মাধ্যমে দেনা পরিশোধের প্রস্তাব করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি আয়োজিত ‘ই-কমার্স খাতের চ্যালেঞ্জ: সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এই প্রস্তাব আসে।
বক্তারা বলেন, হাজারো অভিযোগের মুখে থাকা ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর অনিয়ম ঠেকাতে বিদ্যমান আইনই যথেষ্ঠ। প্রয়োজন শুধু সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সততা, সমন্বয় ও সক্ষমতা বাড়ানো।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম বলেন, আইনের অভাব নাই, নতুন আইনেরও দরকার নাই। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা যদি বাড়ানো যায় এবং সেই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সততার সাথে কাজ করে তাহলে এ ধরনের অনিয়ম ঠেকানো যাবে।
“বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) যেসব আইন আছে, তা দিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।”
বিভিন্ন আইনের বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো ‘পদে পদে অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে’ মন্তব্য করে প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উদাহরণ টানেন কর্পোরেট আইন বিশেষজ্ঞ তানজিব।
তিনি বলেন, কোন কোন অবস্থায় প্রতিযোগিতা কমিশন পদক্ষেপ নেবে সেগুলো প্রতিযোগিতা আইনে বলা আছে। কিন্তু আমরা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, প্রতিযোগিতা কমিশনের যখন যেখানে তৎপর হওয়ার দরকার ছিল, তখন ওনারা বসেছিলেন, পদক্ষেপ নেন নাই।”
ই-কমার্সের কয়েকটি কোম্পানির টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়ায় ভোক্তা অধিদপ্তরে প্রায় ১৭ হাজার অভিযোগ পড়ার তথ্য তুলে ধরে তানজিব বলেন, কিন্তু এতো বেশি অভিযোগ নিয়ে কাজ করার মতো জনবল ও দক্ষতা কোনটাই ওই প্রতিষ্ঠানের নেই। অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নেতৃত্ব দিতে পারতো বলে মনে করেন আর্থিক খাতের শীর্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইভ্যালির লেনদেন একমাস বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরপর ওই নিষেধাজ্ঞা আর বাড়ানো হয়নি অথবা নিষেধাজ্ঞা বলবৎও রাখা হয়নি।
“তখন স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ মনে করল, যে বিএফআইইউ এ বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করেছে বা পরীক্ষা করে দেখেছে তাহলে সমস্যা নেই। তখন ইভ্যালি আরও শতগুণ মনোবল বাড়িয়ে আরও ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, গত আট মাসে ই-কমার্সে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সুতরাং সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণেই জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তানজিব বলেন, বিএফআইইউর ঘটনার পর আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি সংস্থাকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু তারা দুই রকম প্রতিবেদন দিল। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই ঘটনার বিস্তারিত তদন্তে যে রকম জ্ঞান ও দক্ষ লোকবল দরকার তা নেই। সুতরাং বিষয়টি এভাবেই ঘোলা হয়েছে। এখন জনগণের পাওনা টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন? অনেকে বলাবলি করছে, যে সরকারি অর্থায়ন থেকে জনগণের পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হোক।”
এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “জনগণের করের টাকা সরকারের কাছে আমানত। একজনের লুটপাটের টাকা পরিশোধে আমি ট্যাক্স দিইনি- এটা সংবিধানবিরোধী। তাই এখন কোম্পানি আইন অনুযায়ী ওই কোম্পানিকে অবসায়ন করে যে অর্থ পাওয়া যায় তা দিয়ে পাওনা পরিশোধ করা যেতে পারে।
“এক্ষেত্রে যে লোকের ২০ হাজার টাকা পাওনা আছে তাকে এক হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব হলে, তাকে ওইটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই করের টাকায় এই পাওনা পরিশোধ করা যাবে না।”
ব্রাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আরএফ হোসাইন বলেন, ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় বিপদ সংকেত দিয়েছে। ইভ্যালিসহ সম্প্রতি যা ঘটেছে তা সকল পক্ষের লোভের কারণেই হয়েছে।
“এখন জনগণের বিপুল পাওনা টাকা কোথায় আছে, তা খুঁজে বের করে যেটুকু পাওয়া যায়, তাই ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সবগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই ই-কমার্স খাত নিয়ন্ত্রণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।