বিশেষ প্রতিবেদক
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছিল ভারতে পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশনের শেষ সপ্তাহের প্রথম দিন। অধিবেশনে অনেকগুলো জরুরি বিল তখনও পাস করানোর বাকি, অথচ হাতে সময় খুব কম। কাজেই ট্রেজারি বেঞ্চের ব্যস্ততা ছিল তুঙ্গে। রাজধানী দিল্লিতে নেতা-মন্ত্রীদের দৌড়াদৌড়ি চলছিল যথারীতি। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে আস্থাভাজন তিন সহযোগী- পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, তাদের সতর্ক নজর রাখতে হচ্ছিল একটি প্রতিবেশী দেশের (বাংলাদেশ) খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের (গণ-অভ্যুত্থান) দিকে। তবে ৫ আগস্ট সকালেও দিল্লির নীতিনির্ধারকরা আঁচ করতে পারেননি ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবেন শেখ হাসিনা। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
সেদিন সকাল থেকেই বাংলাদেশে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দিয়ে লাখ লাখ বিক্ষোভকারী রাজধানী অবরুদ্ধ করে ফেলার কথা- (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা কীভাবে সেই পরিস্থিতি সামাল দেন, এই ‘ত্রয়ী’ চোখ রাখছিলেন সেদিকেই। কারণ, সেই আন্দোলনের পরিণতি যাই হোক, ভারতের ওপর তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়তে বাধ্য। তাদের প্রত্যেকের কাছেই গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ‘ব্রিফ’ ছিল- শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হয়তো এই সংকটও ‘সারভাইভ’ করে যাবেন।
ঠিক এ জন্যই ৫ আগস্ট সকালেও ভারত সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি, দিনের শেষে সেই শেখ হাসিনাই নাটকীয় পরিস্থিতিতে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবেন। এমনিক, ৫ আগস্টের আগে শেষবার (সম্ভবত ৪ আগস্টেই) যখন হটলাইনে হাসিনার সঙ্গে মোদির কথাবার্তা হয়, তখনও এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনাই হয়নি।
তবে দুই দেশের দুই সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান, ভারতের জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী ও বাংলাদেশের জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অবশ্য তার কয়েক দিন আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগে ছিলেন। পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল এবং বাংলাদেশের মাটিতে সেনা পাঠানোর কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও ভারত যে অন্য সব রকমভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত, সেই বার্তাও দিয়ে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট যেভাবে ঘটনাপ্রবাহ মোড় নিল বা ‘আনফোল্ড’ করল, তার জন্য দিল্লি যে ঠিক ‘প্রস্তুত’ ছিল সে কথা বলা যাবে না। কারণ, জীবন বাঁচাতে শেখ হাসিনাকে শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগ করতে হবে- প্রায় ধরেই নেওয়া হয়েছিল এ রকম সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।
শেখ হাসিনা নিজে এসেছিলেন তো বটেই, সেদিন রাতের মধ্যেই ভারতীয় দূতাবাসের বেশিরভাগ কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কমার্শিয়াল ফ্লাইটে কলকাতা বা দিল্লি উড়িয়ে আনা হয়েছিল। বাংলাদেশে চলমান (তখনকার) আন্দোলনের একটা স্পষ্ট ‘ভারতবিরোধী’ মাত্রা আছে- এটা জানা থাকলেও ঢাকায় ভারতের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রধান কেন্দ্র ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে সে দিনই ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে, এটাও ভারতীয় কর্মকর্তাদের কল্পনার বাইরে ছিল।
আসলে ৫ আগস্ট সকালের পর থেকেই বাংলাদেশে একটার পর একটা নাটকীয় ডেভেলপমেন্ট ওই দিন দিল্লির সব অঙ্ক এলোমেলো করে দিয়েছিল।
ঢাকা থেকে দিল্লিতে পরপর দুটি ফোন : ৫ আগস্ট দুপুর ১২টার পর প্রায় একই সময় নাগাদ ঢাকা থেকে দিল্লিতে পরপর দুটি ফোন আসে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর নিজেই পরে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে যে তথ্য নিশ্চিত করেছেন। প্রথম ফোনটা এসেছিল খোদ শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে, কথা বলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। জয়শংকর অবশ্য ভাঙেননি তিনি কার কাছে ফোন করেছিলেন, তবে প্রটোকল বলে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত কথা হয়ে থাকে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেই।
ভারত ততক্ষণে জেনে গেছে, দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পর হাসিনা পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এর পরই দিল্লিতে টেলিফোন করে তিনি অনুরোধ করেন, তাকে ‘তখনকার মতো’ ভারতে আসার অনুমোদন দেওয়া হোক। সেই অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গেই ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ফোনটা আসে একটু পরেই, বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর কাছ থেকে দিল্লিতে ভারতের এয়ারফোর্স কমান্ডের কাছে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী সামরিক বিমান যাতে ভারতের নির্দিষ্ট কোনো বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করার অনুমতি পায়, আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ‘ক্লিয়ারেন্স’ চেয়ে করা হয় এই দ্বিতীয় ফোনটা। সেই অনুমতিও দেওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গেই।