বাংলাদেশে এ বছর এমন একসময়ে বাজেট ঘোষণা হচ্ছে, যখন দেশটিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক সংকট চলছে, সেই সঙ্গে বছর শেষে হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। মূল্যস্ফীতি কমানো, আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন, রাজস্ব আয় বাড়ানো, রপ্তানি বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানো এবং নির্বাচনের বছরে স্বল্প আয়ের মানুষের সন্তুষ্টির দিকটিও লক্ষ্য রাখতে হবে সরকারকে।
শনিবার (২১ মে) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।
ঢাকার গ্রিনরোডের বাসিন্দা শাহরিয়ার জামান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে যে বেতন ভাতা পান, তা দিয়ে গত কয়েক বছর ভালোই চলছিল। কিন্তু গত বছর থেকে ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলানো তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেছেন, বড় অংকের টাকা ট্যাক্সে চলে যায়। তার ওপর প্রতিটা জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেতনের টাকা তো চলেই যাচ্ছে, মাঝে একবার অসুস্থ হয়ে একটা সঞ্চয় ভেঙে ফেলতে হয়েছে।
সামনের বাজেটে তার জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা আসে কিনা, আয়করের সিলিং বাড়ানো হয় কিনা, তিনি সেটা দেখার জন্য যেমন অপেক্ষা করছেন, আবার শুল্ক-কর বাড়ানো হলে অনেক জিনিসের দাম আরেক দফা বেড়ে যাওয়ারও ভয় পাচ্ছেন। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, অন্যসব বছরের তুলনায় এ বছরের বাজেট কিছুটা চ্যালেঞ্জের হয়ে উঠবে।
সরকারকে একদিকে জাতীয় নির্বাচনের কথা বিবেচনায় রেখে জনতুষ্টির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তগুলো বাস্তবায়নেরও চাপ থাকবে। ফলে এর সঙ্গে ভারসাম্য রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায় আর প্রবৃদ্ধির ওপর সরকার কতটা গুরুত্ব দিতে পারবে, সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
জাতীয় সংসদে জুনের শুরুতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হতে পারে। সবমিলিয়ে এ বছর সাড়ে সাত লাখ কোটির বেশি টাকার বাজেট হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্বাচন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি কারণে এ বছরের বাজেটের সামনে বড় কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অতীতে দেখা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে যেসব বাজেট দেওয়া হয়, সেখানে অর্থনীতির উন্নতির তুলনায় জনতুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট ঘোষণা করা হয়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, আগের নির্বাচনী বছরগুলোকে যদি দেখেন, সেই সময় অর্থনীতি তেমন একটা সংকটের মধ্যে ছিল না। অধ্যাপক রায়হান বলেন, সে সময় জনতুষ্টির বাজেট করেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন বড় ধরনের কোনো চাপ তৈরি হয়নি। কিন্তু এবার যদি নির্বাচনকে সামনে রেখে শুধু জনতুষ্টির কথা বিবেচনা করেই বাজেট করা হয়, সেটা অর্থনীতির ওপর নতুন চাপ তৈরি করবে। তিনি মনে করেন, বাজেটে এ ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য রাখতে হবে। সেজন্য অতিরিক্ত খরচ এড়িয়ে চলা এখনি প্রয়োজন হবে না এমন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কেবল জনতুষ্টিমূলক বাজেট দেওয়ার সুযোগ খুব সীমিত বলে মনে করেন বেসরকারি আরেকটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচনের আগে আগে সব সরকারই জনতুষ্টিমূলক বাজেট দিতে চায়। কিন্তু আর্থিক অবস্থা, রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক ঘাটতির কারণে সরকারের সামনে সে জন্য সুযোগ খুব সীমিত। সেরকম বড় কোনো চেষ্টা করতে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের ভেতর এক ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাজেট আসছে। এর মধ্যে এলডিসি থেকে বের হওয়া, বাস্তবায়ন করা, কোভিড উত্তর পুনরুজ্জীবন বাস্তবায়ন করা, এ সবগুলো বিষয় বাজেটের সামনে রয়েছে। এগুলো বাংলাদেশের পলিটিক্যাল ইকোনোমির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এ বছরের বাজেটে কী ধরনের প্রস্তাবনা করা হয়, সেটির দিকে অর্থনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষ সবাই তাকিয়ে রয়েছেন। সেটা রক্ষা করাই এ বাজেটের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে বলে মনে করেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবারের বাজেট অনেক জটিল পরিস্থিতিতে তৈরি করতে হয়েছে। কারণ আগে দেখা যেত, দেশে আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকতো, কিন্তু বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে তুলনামূলক স্বস্তি থাকতো। কিন্তু এবার সেটা নেই। তিনি বলছেন, প্রবৃদ্ধির যে ধারা ছিল, সেই ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যত্যয় এসেছে। এটা আরো কমে যাচ্ছে, কারণ টাকাও নেই, ডলারও নেই। দুটি ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ফলে আগামী বছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও সংযতভাবে দিতে হবে। আর্থিক কাঠামোটা আসলে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মহামারির কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে পরপর দুই বছর অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছিল, সেটা ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছে, বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এ বছরেও সে অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। এ জন্য দেশের অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশলগত ত্রুটিকেও দায়ী করেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল নয় দশমিক ৩৩ শতাংশ। সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক রায়হান বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী করা হচ্ছে, বাজেটে সেটার পরিষ্কার ধারণা তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্বের বাজারে অনেক কিছুর দাম কমে আসলেও তার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। এসব সংকট কীভাবে সামলানো হবে, তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বাজেটে থাকা দরকার। না হলে বড় সংখ্যক একটা জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যাবে।
এদিকে, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, আসছে বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা কিছুটা বাড়তে পারে। তবে সেটি কতটা বাড়তে বাড়ে, সে বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি।
সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, আগামী বাজেটের মূল্যস্ফীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাজেট হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। সেই সঙ্গে করোনার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়াই বাজেটের মূল লক্ষ্য।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে বরাবরই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, কখনোই সেটা পুরোপুরি সফল করা যায় না। অধ্যাপক রায়হান বলেন, রাজস্ব আদায়ের জায়গায় আমাদের সাফল্য খুবই কম। বরং আমার মনে হয়, আমরা পেছন দিকে হাঁটছি। এটা কম হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক কর্মসূচির মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামাজিক খাতে আমরা সেভাবে ব্যয় করতে পারছি না।
এ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হলেও সেখানে এখনো ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এ বছর আরো বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্তে জিডিপির অতিরিক্ত দশমিক পাঁচ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু শুল্ক-কর ছাড় সুবিধা বাতিল, কর অবকাশ সুবিধা কমানোর প্রস্তাবনা আসতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বেশ কিছু খাতের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা তুলে দেওয়া হতে পারে।
ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এবং বৈদেশিক মুদ্রা : অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে অস্থিতিশীলতা রয়েছে, তা সমাধানে মূল্যস্ফীতি, বিনিময় মূল্যের অস্থিরতা, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি কমিয়ে আনা আর রিজার্ভ কমে যাওয়া, এসবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বাজেটে।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আশঙ্কা করছেন, বৈশ্বিক মন্দা অবস্থার কথা বিবেচনা রেখে, উন্নত দেশগুলোয় পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগে। এ সবগুলো খাতই কিছুটা সংকটের মধ্যে রয়েছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ চলতি বাজেটে এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। আসছে বাজেটে এ বিষয়ে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, খেলাপি ঋণ আদায় করা, ভর্তুকি কমানোসহ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের যেসব শর্ত রয়েছে, এ বাজেটে নেপথ্য ছায়া আকারে সেটাও বেশ গুরুত্ব পাবে।