হাসিবুল হাসান ও আব্দুল্লাহ আল মামুন মিশু;
গোয়ালন্দ উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম মণ্ডল একসময় এনজিওতে এক হাজার টাকার বেতনে সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা করে এখন তিনি কোটি টাকার মালিক।
থাকেন শহরের প্রধান সড়কের আলিশান বাড়িতে, চড়েন বিলাসবহুল গাড়িতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- টাকার জোরে ২০১৩ সালে তিনি যুবলীগের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।
২০০৩ সালের দিকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) পায়াক্টে (বাংলাদেশ) কাজ করতেন নজরুল। পায়াক্টের স্থানীয় কর্মকর্তা শেখ রাজীব জানান, নজরুল মণ্ডলের সঙ্গে একই প্রকল্পে তিনিও কাজ করেছেন।
যুগান্তরকে তিনি বলেন, আমি ও নজরুলসহ ১০ জন পিআর অর্গানাইজার হিসেবে পায়াক্টে যোগ দিই। তখন শুরুতে আমাদের বেতন ছিল এক হাজার টাকা। এ প্রকল্প তিন বছর চলে।
এ প্রকল্পের পর নজরুল অন্য প্রকল্পে চলে যায়। পায়াক্টের প্রকল্প কর্মকর্তা মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় নজরুল সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তার বেতন ছিল মাত্র এক হাজার টাকা।
স্থানীয়রা জানান, রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পর তার অবস্থা পাল্টে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পায়াক্টের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এক দশকেই তার সবকিছু বদলে যায়।
জরাজীর্ণ পৈতৃক বাড়ি নদীতে ভেঙে গেলে তিনি আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেন। তবে তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান নেই। অভিযোগ- নজরুলের আয়ের বড় উৎস ইয়াবা ব্যবসা। ইয়াবাসহ কেউ আটক হলে তিনি তদবির করে থাকেন।
তার ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করেন উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন শেখ। ২৭ সেপ্টেম্বর দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে ইয়াবাসহ আলাউদ্দিন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
একই স্থান থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ইয়াবাসহ দৌলতদিয়া ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আইয়ুব আলী খান ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার শাজাহান গ্রেফতার হন। তারা নজরুলের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
যুবলীগ নেতা নজরুল মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাড়িওয়ালি লিপির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে তিনি জড়ান। এরপর তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার প্রায় অর্ধকোটি টাকা নজরুল হাতিয়ে নেন।
পৌর নির্বাচনের পর লিপি বিয়ের চাপ দেয়। তবে রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। পত্রপত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নজরুলের নাম উঠে আসে। তবে লিপির মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়।
প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ময়নাতদন্ত পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। মামলাও করতে দেয়া হয়নি। লিপির মা যুগান্তরকে জানান, তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। ঘরে তালা দিয়ে নজরুলের লোকজন তাদের জোর করে বের করে দিয়েছে। ধারের একটা টাকাও নজরুল ফেরত দেয়নি। উল্টো জোর করে বাড়ি বিক্রি করে সব টাকা কেড়ে নেয়া হয়েছে।
২০১৪ সালে টেন্ডার নিয়ে বিরোধের জেরে গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সামনে ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন খুন হন। অভিযোগ- নজরুলের মদদে জাহাঙ্গীর খুন হন। খুনিদের পালিয়ে যেতে তিনি সহায়তা করেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, নজরুলের সম্পর্কে এলাকার প্রায় সবাই জানে; কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আশরাফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আগে তো নজরুলের ভাঙা ঘর ছিল। সংসার চালানোই কঠিন ছিল তার। কিন্তু কয়েক বছরে সবকিছু বদলে গেছে। কীভাবে হয়েছে তা বলতে পারব না। তবে এখন গোয়ালন্দ শহরের প্রধান সড়কের বিলাসবহুল বাড়িতে তিনি থাকেন। একাধিক গাড়িতে চলাফেরা করেন।
দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় নজরুলের আধিপত্য আকাশছোঁয়া। যানবাহন পারাপারের ওপর তার প্রভাব রয়েছে। পারাপার হওয়া মাছ, গরু, পান বা ফলবাহী প্রতিটি ট্রাক থেকে নজরুল চাঁদা নেন। ট্রাকপ্রতি তাকে ৫২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।
এছাড়া দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথের নাব্য ঠিক রাখতে প্রায় সারা বছর বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং কার্যক্রমের তেল লোপাট করে নজরুল কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। চলাচলকারী ফেরির তেল চুরিও তার নিয়ন্ত্রণে। দৌলতদিয়া যৌনপল্লী থেকেও নজরুল আয় করেন কোটি কোটি টাকা।
নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ- টাকার জোরে তিনি ২০১৩ সালে গোয়ালন্দ উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। গোয়ালন্দ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাকে পেছনে ফেলে দল থেকে তিনি আদায় করেন নৌকার টিকিট।
তবে জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হওয়ার পরও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে নজরুল বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নজরুল ইসলাম মণ্ডলের মোবাইল ফোনে বারবার কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। শনি ও রোববার দুইদিন একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। যুগান্তরের রিপোর্টার পরিচয়ে তাকে এসএমএস পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে গোয়ালন্দ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ইউনুস মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, নজরুলের বিরুদ্ধে ঘাট থেকে চাঁদাবাজি এবং ইয়াবা ব্যবসার কথা আমরাও শুনেছি। তিনি বলেন, আমাদের কথা পরিষ্কার- আওয়ামী যুবলীগের রাজনীতিতে অপরাধীদের স্থান হবে না। চাই না কোনো অপরাধী যুবলীগের নাম ব্যবহার করে অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুক। অবশ্যই অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সম্প্রতি নজরুল মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে শুদ্ধি অভিযান ও ক্যাসিনো-কাণ্ডের কারণে সংগঠন থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতা যুগান্তরকে বলেন, এমন বেশকিছু অভিযোগ যুবলীগের কেন্দ্রে জমা পড়েছে। শুদ্ধি অভিযান, ক্যাসিনো-কাণ্ড, সম্মেলনসহ নানা ব্যস্ততায় সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাচ্ছে না। তবে কেন্দ্রের মতো তৃণমূল পর্যন্ত যুবলীগকে শিগগিরই ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু হবে।